সারা দেশ

মালিকদের কারসাজিতে ১৭ বছর ধরে উপেক্ষিত শ্রম আইন

মালিকদের কারসাজিতে ১৭ বছর ধরে উপেক্ষিত শ্রম আইন

শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, কার্যকালে দুর্ঘটনা জনিত কারণে শ্রমিকের জখমের জন্যে ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প বিরোধ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকুরীর অবস্থা ও পরিবেশ শিক্ষাধীনতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার শ্রমও আইন ২০০৬ তৈরি করেছে।বাংলাদেশ সরকারের এ আইন দেশের বেসরকারি বিভিন্ন শিল্প সেক্টরে বাস্তবায়ন করা হলেও বৃহৎ শিল্প সেক্টর দেশের তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানায় মালিকদের কারসাজিতে ১৭ বছর ধরে উপেক্ষিত বলে জানিয়েছেন পোশাক শ্রমিকরা।

১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওইদিন তাদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর পর থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে।সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যথাযথ মর্যাদায় প্রতি বছর পালন করা হয় মহান মে দিবস।প্রতি বছর মে আসে আর যায়। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের অভাব-অনাটন, দুঃখ-দুর্দশার কথা সভা সেমিনারের মধ্যেই পড়ে থাকে। দৃশ্যমান কোন আশানুরূপ উন্নতি হয় না।

বর্তমান বাজারে দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির জাতাকলে অর্থনৈতিক ভাবে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার দ্বার প্রান্তে এসে পড়েছেন শ্রমিকরা। পোশাক শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে প্রথমে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পরে সারা দেশেই ব্যাপক বিক্ষোভ ও শ্রমিক আন্দোলন গড়েন। এ সময়ের তীব্র আন্দোলনের মধ্যে সরকার পোশাক শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী নুন্যতম মজুরি ২৫ হাজার টাকার পরিবর্তে চলতি বছরে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। এর পরেও সরকার ঘোষিত নতুন এ মজুরি মেনে নিয়েছেন এ শিল্পে জড়িত ৪০ লাখ শ্রমিক।বৃহৎ এ শিল্প সেক্টরে হাজার-হাজার পোশাক শ্রমিকদের মতে, বেতন বাড়লেও অর্থনৈতিক মুক্তি মিলছে না তাদের। যতটুকু বেতন বাড়ানো হয়েছে তার চেয়েও বেশি বাজারে দ্রব্য মূল্য বেড়েছে।

তাই বাজারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সহনশীল পর্যায়ে রাখা অতি জরুরি। সরকার যদি এটা না করতে পারে তাহলে শ্রমিকদের এই বাড়তি বেতন শ্রমিক পরিবারে অর্থনৈতিক ভাবে কোন সুফল বনে আনবে না। শুধু তাই নয়, এর পাশাপাশি বছরের পর বছর জুড়ে কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের জন্য আবাসন সুবিধা প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন, এটাও শুভঙ্করের ফাঁকি।এ থেকেও অতিদ্রুত মুক্তি চায় শ্রমিকরা।দেশের বৃহত্তর পোশাক শিল্পাঞ্চল গাজীপুরের পোশাক শ্রমিকরা বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্য ছাড়াও তারা কারখানার ভেতরে ও বাইরে মালিকপক্ষের পালিত লোকজনদের দ্বারা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।

এর মধ্যে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী শ্রমিকরা আরও বেশি অবহেলিত।অধিকাংশ নারী শ্রমিকই নিয়োগপত্র পান না, ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তবু বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিকরা থেমে নেই। নিত্যদিনের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতাসহ শারীরিক নানা ধরনের রোগব্যাধি; সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতনকে মাড়িয়েই তারা শ্রম দিয়ে চলেছেন। নিজেরাই হয়তো জানেন না তাদের কাঁধেই সওয়ার হয়েছে দেশের অর্থনীতি।বাংলাদেশ রপ্তানি ব্যুরোর তথ্য সূত্রে জানা গেছে, অক্লান্ত পরিশ্রমী পোশাক শ্রমিকদের ঘামেই গত অর্থবছরেও ৪ হাজার ৪১৩ কোটি ৩১ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য রফতানি করেছে দেশ, যা মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ।

গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী এলাকায় একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করেন মোছা. হাসিনা আক্তার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, মাত্র ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পাই। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্বামী নিয়ে আমার পরিবার। তিনি বলেন, স্বামী দিনমজুর, তার রোজগারের টাকা চলে যায় বাসা ভাড়ায়। আমি যে বেতন পাই এটা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই।এখন একটু ওভার টাইম আছে সেজন্য একটু বেশি বেতন পাচ্ছি। সামনে ওভার টাইম কমে গেলে কি ভাবে চলমু এ কথা ভাবলেই চোখে জল আসে।রেনেসা গ্রুপের পোশাক কারখানার শ্রমিক মো. উজ্জ্বল মিয়া বলেন, মে দিবস পালন করে কি হবে।

যে দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম এর মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। সেই শ্রমিকদের পুলিশ দিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের দাবি অনুযায়ী বেতন পাইনি। তাও মেনে নিয়েছি।আমাদের এখন একাটাই দাবি আন্দোলনের সময় যে সব শ্রমিক ভাই-বোন নিহত হয়েছে। তাদের হত্যাকারীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি চাই। তাইলে এবারের মে দিবস সফল হবে। এর পাশাপাশি আরেকটি দাবি কারখানা মালিকদের প্রতি, তারা যেনো আমাদের দুপুরের খাবার ফ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং থাকার জন্য কোয়াটার ফ্রী দেন।দেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আনু মুহম্মদ।

তিনি বলেন, আমরা সব সময় পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করি।নাগরিক হিসেবে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার মালিকরা সরকারের শ্রম আইন নিয়ে কারসাজি বছরের পর বছর করে যাচ্ছে। শ্রম আইনে শ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্য সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও মালিকরা উল্টো শ্রমিকদের হয়রানি করেন।তিনি আরও বলেন, মহান মে দিবসে পোশাক শ্রমিকদের বলবো তোমারা হতাশ হবে না। বিশেষ করে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে যে পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা রাস্তায় আন্দোলন করছিলেন, সেই পরিস্থিতি ও তাদের দাবি পর্যালোচনা আন্দোলন নিয়ে মালিকপক্ষ, পুলিশ, বিজিএমইএসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাসহ শ্রমিকদের মজুরি, কর্ম পরিবেশ, ইত্যাদি দিক নিয়ে গভীর অনুসন্ধান চালাব। ঘটনার পিছনে যারা দায়ী তাদের উন্মোচিত করা হবে।

অপরদিকে দেশের পোশাক শিল্প কারখানার শ্রমিকদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি তরান্বিত করার কাজে জড়িত সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংগঠন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দ্বায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রাণকেন্দ্র তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি ও শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে আধুনিক বিশ্বে হুমকির মুখে পড়ে বৃহৎ এ শিল্প।

আরও খবর

Sponsered content