রাজনীতি

বিএনপির তৃণমূল ভোটের মাঠে গেলেই দলীয় শাস্তি

বিএনপির তৃণমূল ভোটের মাঠে গেলেই দলীয় শাস্তি

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একদফা দাবি আদায়ে আন্দোলনরত বিএনপি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এখন নির্বাচন ঠেকানোর পাশাপাশি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী ক্রিয়া থেকে বিরত রাখা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে দলটির নীতিনির্ধারকদের।শুধু রাজপথে আন্দোলন নয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাংগঠনিকভাবেও কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে যেসব নেতা নির্বাচন করছেন এরই মধ্যে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।

তবে সেখানেই ক্ষান্ত হচ্ছে না দলটি, তৃণমূলের কোনো নেতাকর্মী কোনো দলের বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারসহ কোনোভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।দলের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরের দায়িত্বশীল নেতারা এ বিষয়ে সারা দেশে নজর রাখছেন। পাশাপাশি একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনে নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী প্রচার। আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ভোট। নিবন্ধিত ২৭টি দলের মনোনীতদের পাশাপাশি ভোটের লড়াইয়ে আছেন ৩৮২ স্বতন্ত্র প্রার্থী। ফলে বিএনপিসহ বেশ কিছু নিবন্ধিত দল বয়কট করলেও এবার সংসদের ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে।আগে থেকেই গুঞ্জন ছিল, বিএনপি নির্বাচনে না এলে এবার দলটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা বিভিন্ন দলে যোগ দিয়ে প্রার্থী হবেন।

পুরোপুরি ঠিক না হলেও নবগঠিত একাধিক দলের ব্যানারে নির্বাচনী লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন বিএনপির বেশ কয়েক নেতা।এ ছাড়া দলীয় অবস্থানের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন কয়েকজন। ফলে স্থানীয়ভাবে ওই নেতাদের অনুসারী বা সমর্থকরাও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।সেইসঙ্গে আত্মীয়তা বা সম্পর্কের খাতিরে অন্যান্য দলের প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় তৃণমূলের কেউ কেউ যুক্ত হতে পারেন বলেও আশঙ্কা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কাউকেই ন্যূনতম ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একদফা দাবি আদায়ে আন্দোলনরত বিএনপি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এখন নির্বাচন ঠেকানোর পাশাপাশি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী ক্রিয়া থেকে বিরত রাখা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে দলটির নীতিনির্ধারকদের।এ ক্ষেত্রে দলের সাংগঠনিক ঐক্য অটুট রাখতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা করছে না বিএনপির হাইকমান্ড। সাংগঠনিক নির্দেশনা উপেক্ষা করে যারাই নির্বাচনে গেছেন তাদের তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার যে কোনো পর্যায়ে কেউ সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। এবারের ‘পাতানো সিলমোহরের নির্বাচনে’ যারাই অংশ নিচ্ছেন বা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন, তাদের প্রতি আহ্বান, যদি ন্যূনতম দেশপ্রেম, মনুষ্যত্ব ও বিবেক- বিবেচনাবোধ থাকে, তবে ফিরে আসুন। আপনারা মীর জাফরের উত্তরসূরি হবেন না।১৮ কোটি মুক্তিকামী মানুষের ঘৃণা রুদ্ররোষের শিকার হবেন না। প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ভাগবাটোয়ারার পাতানো নির্বাচনে সহযোগিতা করবেন না। ভোটাররা ভোটদান থেকে বিরত থাকুন। যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তারা বর্জন করুন।

অন্যথায় এই অমার্জনীয় অপকর্মের জন্য জনগণ আপনাদের ক্ষমা করবে না। ইতিহাসের পাতায় আপনাদের নাম বেইমান-মীর জাফরের পাশে লেখা থাকবে। ১২ কোটি ভোটারের কাছে আমাদের আহ্বান, আপনারা কারও প্রহসনের নির্বাচন করার স্বার্থসিদ্ধিতে অংশ নেবেন না।’জানা যায়, গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শৃঙ্খলাবিরোধী অভিযোগে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

এর মধ্যে আছেন ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান, তাঁতীবিষয়ক সহ-সম্পাদক রাবেয়া ভূঁইয়া, নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, শাহ শহীদ সারোয়ার, মতিউর রহমান মন্টু এবং খন্দকার আহসান হাবিব ও এ কে এম ফখরুল ইসলাম।এ ছাড়া ঢাকা, টাঙ্গাইল, শেরপুর, পঞ্চগড়, জামালপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, পিরোজপুর এবং খুলনার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেককে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

গত ৩০ নভেম্বর বিএনপির সাবেক নেতা শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়েছেন। এর আগে নতুন নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিয়ে শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর ফরিদপুর-৪ এবং মতিউর রহমান মন্টু রাজশাহী-৩ আসনে, ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠন করে খন্দকার আহসান হাবিব টাঙ্গাইল-৫ আসনে এবং এ কে এম ফখরুল ইসলাম ঝালকাঠি-২ আসনে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে এবং শাহ শহীদ সারোয়ার ময়মনসিংহ-২ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। প্রত্যেককেই তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কার করে বিএনপি।

এদিকে কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদি-পাকুন্দিয়া) আসনের প্রার্থী বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ায় মঙ্গলবার দুজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার শহীদ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কটিয়াদি উপজেলার মুমুরদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন সাবিরি ও চান্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দিনকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’

এর আগে গত ১১ ও ১৩ ডিসেম্বর খুলনা জেলা বিএনপি নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা তৈরি করে মৌখিকভাবে সতর্ক করে। পরবর্তী সময়ে ১০ নেতাকে লিখিতভাবে শোকজ এবং একজনকে বহিষ্কার করা হয়। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নিষ্ক্রিয় নেতাদের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।গত ১১ ডিসেম্বর পিরোজপুরে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ায় স্বেচ্ছাসেবক দলের তিন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় ভাবমূর্তি ও শৃঙ্খলাপরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১০ ডিসেম্বর ফরিদপুর-১ আসনের আওতাধীন মধুখালী, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির ১২ নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

ফরিদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেস আলী ঈসা জানান, দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন পরিপন্থি কার্যকলাপে জড়িত থাকার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে।জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘বিএনপি যেহেতু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, তাই দলের কেউ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার প্রশ্নে বিএনপি অটল রয়েছে। ফলে দলের কোনো নেতাকর্মী এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিলে তার বিরুদ্ধে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে—এটিই স্বাভাবিক’।