এক্সক্লুসিভ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ ইয়ামিনের স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার

মাহমুদ শরীফ

শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে শহীদ হওয়া এক অকুতোভয় দেশপ্রেমিক তরুণ। তার লাশ নিয়ে চরম নির্মমতা বিশ্ববিবেককেও নাড়া দিয়েছে। একটি ছবি বা এক ক্লিপ ভিডিও ফুটেজ একটি ইতিহাস হতে পারে এটা তার জ¦লন্ত প্রমাণ। অধিকার আদায় আর ফ্যাসিষ্টদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে জীবন দিয়ে ইয়ামিন আজ মরেও অমর। রংপুরের আবু সাইদ, ঢাকার মীর মুগ্ধ আর ইয়ামিনদের জীবন ও তপ্ত লহুর বিনিময়েই আজকের স্বস্থির নিঃশ্বাস। পলায়নের মাধ্যমে ফ্যাসিষ্টদের পতন।

১৮ জুলাই ২০২৪ দুপুর ২টা। সাভার বাস স্ট্যান্ডের পুরাতন ওভারব্রিজের পাশে পুলিশের এপিসিটি অবস্থান করছিল। ওদিকে মহাসড়েকের বিপরীত দিক থেকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ইয়ামিন কোনো এক ফাঁকে প্রথমে সার্ভিস লেন, পরে মূল সড়কের বিভাজক টপকে এপিসিটির ওপরে উঠে যায়। এপিসির উপর উঠার পরপরই বুকের বাম পাশে ছররা গুলির আঘাতে এপিসির ছাদেই লুটিয়ে পড়লো সে। সাভারের রানা প্লাজা ও ভ্যাট অফিসের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছানোর পর এপিসির ভিতর থেকে একজন পুলিশ সদস্য একটি দরজা খুলে এবং আরেকজন হ্যাচ খুলে উপরে উঠে এসে ইয়ামিনকে রাস্তার উপর ফেলে দেয়, যা ছিল অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিক। তার পরনে ছিল নেভি বøু রংয়ের ট্রাউজার এবং গায়ে খয়েরি রংয়ের একটি জামা।

ইয়ামিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই বন্ধ করে দেওয়া হয় এপিসির উপরের প্রবেশ পথের ঢাকনাটি। বাইরে থাকা শতশত পুলিশ সদস্য তখনও মহাসড়কের বিপরীতদিকে থাকা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে একের পর এক ছররা ও রাবার গুলি ছুড়ছিলো। সাথে ফ্যাসিষ্টেদের দোসররাও আক্রোমণ করছে ছাত্র-জনতার উপর।

তখনও জীবিত ছিলেন ইয়ামিন। সড়কে পড়ে থাকা এ শিক্ষার্থীকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে দেখা যায়। তার দুহাত দুদিকে ছড়ানো। পা দুটি ভাঁজ হয়ে পড়ে। একটি পা গিয়ে ঠেকে এপিসির বাম দিকের পেছনের চাকার গায়ে। এ সময় এপিসির বামদিকের দরজা দিয়ে পুলিশের প্রথম সদস্য নেমে ইয়ামিনের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে এপিসির চাকার পাশ থেকে সরিয়ে মহাসড়কের মাঝের দিকে টেনে নিয়ে আসে। এর কয়েক মিনিট পর এপিসিতে থাকা দুজন পুলিশ সদস্য আবারও ইয়ামিনকে ধরে মূল সড়কের বিভাজকের ওপর থেকে সার্ভিস লেনে অমানবিকভাবে ফেলে দেয়।

ইয়ামিনকে যেভাবে প্রথমে এপিসির ছাদ থেকে এবং পরে সড়ক বিভাজক পার করিয়ে সার্ভিস লেনে ফেলা হয়, তাতে মনে হচ্ছিল কোনো মানুষ নন, বরং কোনো পণ্যের বস্তা ফেলা হচ্ছে। করূণ, মর্মান্তিক ও অমানবিক এ দৃশ্য কাঁদিয়েছে অনেককে। কিন্ত তাদের বিবেক একটুও নড়েনি, যারা ফ্যাসিষ্ট আর তাদের প্রেতাত্মা। ইয়ামিনকে সার্ভিস লেনে ফেলে দেওয়ার পরপরই তার অবস্থানের কাছেই একটি টিয়ারশেল পড়ে। শেলের ঝাঁঝালো গ্যাসের কারণে সবাই তখন ইয়ামিনকে সড়কে ফেলে রেখেই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

একঘণ্টা পর কয়েকজন আন্দোলনকারী ইয়ামিনকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদী শুধা পানে তৃপ্ত হয় ইয়ামিন। এ সময় দেখা যায়, শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের বুকের বাম পাশ ও গলায় অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন।

শহীদ ইয়ামিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার সাভারে নিহত প্রথম শিক্ষার্থী। সে রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল।

শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের এই ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচারিত হয় এই দৃশ্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সৈনিক ইয়ামিনকে পুলিশ ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার পর যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, তা সকল বর্বরতাকে হার মানায়।

শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, দুনিয়া-আখেরাত উভয় বিচারে আমার সন্তান শহীদ। তাকে গোসল করানো হয়নি, কাফন দেওয়া হয়নি। বরং যে কাপড়ে সে শহীদ হয়েছে, সে কাপড়েই জানাজা পড়ে দাফন করেছি আমার কলিজার টুকরাকে।

শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে প্রথমে দাফন করার চেষ্টা করেন তাঁর পিতা। সব প্রস্তুতি নেওয়ার পর সেখানকার থানা থেকে জানানো হয়, লাশ সেখানে দাফন করতে দেওয়া হবে না। তারপর সাভারের তালবাগের কবরস্থানে দাফন করার চেষ্টা করলে সেখানেও নানা অজুহাতে বাধা দেওয়া হয়। অবশেষে ব্যাংক টাউন কবরস্থানের সভাপতির আন্তরিক প্রচেষ্টায় সন্তানকে সেখানেই চিরনিন্দ্রায় শায়িত করার সুযোগ পায় অসহায় পিতা।

শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে ও সরাসরি যুক্ত ছিল না। নিরীহ পরিবারের সন্তান হয়েও কোটার বিরুদ্ধে আর সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে ছিল ইয়ামিন। সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করার পর ইয়ামিন বুয়েটে পড়ার সুযোগও পেয়েছিল। তবে গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী শহীদ আবরার ফাহাদকে বুয়েটে ছাত্রলীগ পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভে-দুঃখে সেখানে ভর্তি না হয়ে ইয়ামিন এমআইএসটিতে ভর্তি হয়। স্বপ্ন ছিল ওখানেই মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবে। সেই সব স্বপ্ন আজ বিষাদে পরিণত।

শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন ২০২৪ সালের বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন আন্দোলনকারীই নয়, একটি প্রেরণা, একটি শক্তি, একটি শিক্ষা। তাঁর স্মরণে সাভারের পাকিজা মোড়ে শহিদ ইয়ামিন চত্বর নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশমাইল গেট সংলগ্ন ফুট ওভারব্রিজের নামকরণ করা হয়েছে শহিদ আসহাবুল ইয়াামিন ওভারব্রিজ। কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে প্রতিষ্ঠা করা করা হয়েছে শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের নামে পাঠাগার। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমআইএসটি এর নবনির্মিত অডিটরিয়াম এবং মুক্তমঞ্চের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও এমআইএসটির কেন্দ্রীয় পাঠাগারে শহীদ ইয়ামিন-শহীদ রাকিবুল কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে।

শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন ২০০১ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃনিবাস কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন মা বাবার একমাত্র ছেলে। এক বোন, দুই ভাই-বোনের মধ্যে ইয়ামিন ছোট। ইয়ামিন মাঝে মধ্যেই গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙা গ্রামে ছুটে যেত। বন্ধুসূলভ স্বভাবে সহজেই আপন করে নিত এলাকার কিশোরদের। সবাই মিলে মেঠোপথ, সবুজ মাঠ, পদ্মা-গড়াই নদীতে দূরন্তপনা করত।

ইয়ামিনের গ্রামের বন্ধু ফিরোজ জানায়, ইয়ামিনকে হারিয়ে আমার কিছু ভালো লাগেনা। গ্রামে এলে বিভিন্ন সামাজিক আর ধর্মীয় উৎসব আনন্দে মেতে থাকতো ইয়ামিন। প্রতি বছর গ্রামে এসে জাঁকজমক ভাবে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতো তার পরিবার, সেখানে ইয়ামিনের আথিতিয়তা মুগ্ধ করত সবাইকে। ওর স্মৃতিগুলো আমাকে কষ্ট দেয়। এই কষ্ট কীভাবে আমি সহ্য করব?
আজও ছেলের শার্ট-প্যান্ট বুকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদে বুক ভাসায় ইয়ামিনের মা। তিনি একমাত্র ছেলের খুনিদের ফাঁসি চান। যারা তার বুক খালি করেছে তাদের বিচার চান। বাবার বুক ফেটে গেলেও বলতে পারেন না। দোয়া করেন আর দোয়া চান সবার কাছে।

সাভারের প্রথম শহীদ হিসেবে ইয়ামিনের আত্মত্যাগের পথ ধরেই এসেছে নতুন সূর্য, নতুন বাংলাদেশ, নতুন স্বপ্ন। ইয়ামিনদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব এখন দেশপ্রেমিক সবার।

আরও খবর

Sponsered content