মাহমুদ জামাল :
৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, এই দিনে বেলা প্রায় ৩টার দিকে আমার বাবা শহীদ হন। আমাদের চোখের সামনে বাড়ির পাশে বাগানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোষর রাজাকার আলবদর রা আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। আমাদের বাড়ির লাল বাড়ান্দাতে যখন বাবার লাশটা এনে রাখা হোলো তখন আসরের আজান হচ্ছিলো। তাঁর হাত ফুটো করে একটা গুলি বের গেছে, হাতের তালুতে সব হাড্ডিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। হাত আর পরনের হাফহাতা ছাই রঙের শার্টটা রক্তে ভিজে গেছে। মনে করেছিলাম হাতে ব্যথা পেয়েছেন, হয়তো চিকিৎসা করলে সেড়ে যাবে। তখনো বুঝি নাই আর কোথায় গুলি লেগেছে এবং তা ইতোমধ্যে আমার বাবার প্রাণবায়ু কেড়ে নিয়েছে। আর কখোনো তিনি উঠবেন না। কখনো তাঁর মিষ্টি কণ্ঠের বাবা ডাক শুনতে পাবো না। তাঁর মায়াভরা হাঁসিমুখটা দেখতে পাবো না আর কোনোদিনও। পরে দেখলাম বুকের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট ফুটো হয়ে আছে; আর কোনো চিহ্ন নেই, সেখানে কোনো রক্তও নেই। বাবার মৃত্যুর পর বহুদিন ওই বুকের ঠিক মাঝখানে বেদনা অনুভব করেছি। মনে হয়েছে বুকের মাঝখানটা যেনো আমিও গুলির অনুভূতি পাচ্ছি। রাতে আতংকে ঘুম থেকে উঠে গেছি; মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছি, না আমার বাবা নেই, বিছানায় তাঁর স্থানটি শূণ্য। শুধু বিছানা নয়, তারপরের কতদিন কত রাত বিনিদ্র কেটেছে আমাদের পরিবারের, সংসারের সবটা জায়গা কেমন যেনো নিঃসিম শূণ্যতার ঢেকে গেছে তা ভূক্তভোগি ছাড়া কাউকে বোঝানো যাবে না। এমনই অনেক বাবা, ভাই আর আত্মীয় স্বজনের জীবনের মূল্যে, তাদের হাহাকারের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি বাংলাদেশ।
আমার বাবা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে অনেকদিন আগে; কিন্তু রেখে গেছেন প্রতিনিধি হিসেবে আমার মহিয়সী মাকে, যিনি সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে অতল গহবর থেকে টেনে তুলে এনেছিলেন আমাদেরকে। তাঁর সাথে শুধু আল্লাহ্ ছাড়া ছিলেন না আর কাউকে।
আমার বাবা অত্যন্ত মানবপ্রেমী ছিলেন। তিনি সবসময় মানুষের কণ্যাণের কথাই ভেবেছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবন দিয়ে তাঁকে মানবপ্রেমের মূল্য দিতে হলো।
কুমারখালী তাঁর জন্মস্থান ছিলো না। আমাদের সকল আত্মীয় স্বজন ঢাকায় বসবাস করেন। অথচ তিনি এসেছিলেন এই নিভৃত এলাকায় এবং কুমারখালীর প্রতি মায়ায় বাঁধনে তিনি বাধা পড়ে যান।। যে মানুষটা American Express Bank, Loyeds Bank, Habib Bank দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, শেষ জীবনে এসে ঠিকাদারীর কাজ করতে বাধ্য হন এই কুমারখালীর টানে। কুমারখালী পোর্টং ক্লাব, কুমারখালী পাবলিক লাইব্রেরী, কুমারখালীর নাট্যাঙ্গন তাঁকে এমনই আকর্ষণ করতো যে, ঘুরে ঘুরে বারবার কুমারখালী ফিরেছেন এবং কখনো কখনো চাকরি ত্যাগ করে চলে এসেছেন কুমারখালীতে। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৮ বছর বয়সে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিলেন এই কুমারখালীর মাটিতেই।
আমার বাবা অত্যন্ত নিরংহকার, সাদা মাটা মানুষ ছিলেন। হাসি খুসিতে জীবন কাটাতে পছন্দ করতেন। পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন নিয়ে তিনি অত্যন্ত আমোদে দিন কাটাতেন। আমাদের এমন কোনো আত্মীয় স্বজন ছিলেন না যারা দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাদের কুমারখালীর বাড়িতে আসেননি।
বাবা ছিলেন আমাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক; তাঁর শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতি ছেলো এমনই, যা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। বাবা আমাদের শিখিয়েছেন;
কখনো মিথ্যা বলবে না;
অহংকার করবে না;
কাউকে হিংসা করবে না;
বড়দের প্রদ্ধা ও সম্মান করবে;
ছোটোদের স্নেহ করবে;
নিয়মিত নামায পড়বে;
মানুষকে ভালোবাসবে;
ধর্মের কারণে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করবে না;
এর পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষা তো ছিলোই। নামায না পড়লে বা এই সব শিক্ষার কোনো ব্যত্যয় ঘটলে চরম শাস্তি পেতে হোতো। এমনকি খাবার বন্ধ করে দেয়া হোতো। পরে বড় হয়ে বুঝলাম এগুলো সবই আমাদের প্রিয়নবী (স.) এর শিক্ষা।
বাবার স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে আজও জলজল করছে; তাঁর হাটা চলা, কথা বলার ভঙ্গি, তাঁর হিউমার, তাঁর কর্মকাণ্ড সবই স্মরণে পড়ে। কিন্তু আমাদের সেই সময় দেড় বছর আর তিন বছরের ছোটো দুটি ভাই বোনের স্মৃতিতে তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা জানেনা বাবা কেমন হয়; এই কষ্ট তাঁরা আজও বয়ে বেড়ায়। কী সান্তনা তাদের জন্য রয়েছে কেউ কি বলতে পারবেন!
বাবা চলে গেছে না ফেরার দেশে; সব কিছু চাওয়া পাওয়ার উর্দ্ধে এখন তিনি। প্রতি নামাযের পর বাবার জন্য দোআই এখন সন্তান হিসেবে আমাদের কাছে তিনি চান। তাই কায়মনো বাক্যে দোআ করি আল্লাহ্ যেনো তাঁকে শহীদের মর্যাদা দান করেন, তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন, তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দেন, আমিন!