সারা দেশ

জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে পারুল বেগম

জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে পারুল বেগম

রানা প্লাজার পাঁচতলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসে কাজ করতেন পারুল বেগম। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ভবনটি ধসে পড়লে অনেকের সঙ্গে তিনিও আটকা পড়েছিলেন। আট ঘণ্টা পর তাকে ধ্বংসস্তুপ থেকে বের করে আনেন উদ্ধারকারীরা। পারুলের শরীরের বাম পাশে রডের আঘাত লাগে, আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডান পাশের কিডনিও। ১১ বছরে সেই কিডনির সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রায়ই শরীরে পানি জমে যায়। একটানা বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারেন না বলে দুর্ঘটনার পর আর কোনো কাজে যোগ দিতে পারেননি।

পারুলের স্বামী ইয়াসিন হোসেনও রানা প্লাজা ধসে আহত হয়েছিলেন। তার ডান কানের পর্দা ফেটে যায়। তিন-চার বছর তিনিও কোন কাজ করতে পারেননি, এখন একটা ছোট কারখানায় নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করছেন। সেই আয় দিয়ে কোনোরকমে চলছে সংসার।সেদিনের দুর্ঘটনা পারুল-ইয়াসিনের মতো অনেকের শরীরেই স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। কেউ কেউ হয়েছেন চিরতরে পঙ্গু, হারিয়েছেন কর্মক্ষমতা। কেউ আবার চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে হয়েছে সর্বস্বান্ত। অসুস্থতা, পঙ্গুত্ব আর বেকারত্বের কারণে প্রায় এক যুগ ধরে তারা বয়ে চলেছেন দুর্বিষহ এক জীবন।

রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা দেন এমন কর্মকর্তা এবং তাদের খোঁজ রাখেন এমন শ্রমিক নেতারা বলছেন, আহত শ্রমিকদের অসুস্থতা দিন দিন বাড়ছে। যাদের হাত-পা কাটা পড়েছিল তারা একটা ক্ষতিপূরণ পেলেও যারা মেরুদণ্ডসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন তাদের অনেকেই কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। দীর্ঘদিন কর্মহীন রয়েছেন রানা প্লাজায় আহত অনেক শ্রমিকই।গত বছর প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ। শারীরিক অক্ষমতার কারণে পাঁচ থেকে আট বছর ধরে বেকার ৮৯ শতাংশ শ্রমিক। বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পক্ষে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল বিজনেস (আইএসবি) রানা প্লাজায় আহত ২০০ শ্রমিক পরিবারের মধ্যে সীমাক্ষাটি চালায়।

সম্প্রতি ওই দুর্ঘটনায় আহত ১০ জন শ্রমিক এবং সংগঠক ও চিকিৎসা সেবাদাতা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অসহায় জীবনের চিত্র জানা যায়।তাদের একজন ত্রিশ বছরের সাদ্দাম হোসেন। ২০১৩ সালে টঙ্গী কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় সাদ্দাম কাজ করতেন সাভারের নেসলের এক পরিবেশক সংস্থার কর্মী হিসেবে। তাদের অফিস ছিল রানা প্লাজার পাশের একটি তিনতলা ভবনে।রানা প্লাজা ধসের সময় নিজের অফিসে আটকা পড়েন সাদ্দাম। প্রাণে বাঁচলেও কাটা পড়ে তার ডান হাতটি। দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া সাদ্দাম এক হাত নিয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কিছু ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন, তা দিয়ে দোকানও দিয়েছিলেন। কিন্তু টিকতে পারেননি। এরপর কিছুদিন পরিচিত একজনের সংস্থায় চাকরি করেছেন। তবে অন্তত দুই বছর ধরে একদম বেকার তিনি।

সাদ্দাম বলেন, সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও কোনো চাকরি পাচ্ছি না। এক হাতেই লেখালেখি থেকে শুরু করে সব কাজে অভ্যস্থ হয়েছি। কিন্তু কপালে কিছুই জুটছে না।আহত পারুল বেগম জানান, দুর্ঘটনার সময় কিডনিতে আঘাত পেয়েছিলেন। এরপর কিডনিতে পানি জমত। পরে ডাক্তাররা একটা নল লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে সমস্যা কিছুটা কমলেও এখন দুই-একদিন পরপরই ব্যথায় ভুগতে হয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ ৯০ হাজার টাকা পান। কিন্তু আহত হওয়ার পর তিন-চার বছর তারা কাজ করতে পারেননি। সেই সময় সংসার চালাতে সব জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়। কোভিড মহামারীতে আর্থিক অবস্থা একেবারেই খারাপ হয়ে যায়।

মহামারীর পর একটা কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন। এক সপ্তাহে তিনদিন ডিউটি করতে পেরেছিলেন। তৃতীয় দিন কারখানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে তাকে হাসপাতালে থাকতে হয় তিনদিন। এরপর থেকে আর চাকরির চেষ্টা করেননি। তার স্বামী এখন একটি কারখানার নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।পারুল বলেন, তারা স্বামী-স্ত্রী সাভারের ডগরমোড়ায় রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন্সে দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সহায়তা ট্রাস্টে গিয়ে ডাক্তার দেখাচ্ছেন, সেখান থেকে ওষুধও আনছেন। ১১ বছর ধরে প্রতিদিনই ওষুধ খেতে হচ্ছে তাকে।

জীবন চলছে ধুঁকে ধুঁকে : ধসে পড়া রানা প্লাজার নীচে দুই পা আটকে গিয়েছিল রেহানা আক্তারের। উদ্ধারকর্মীদের সহায়তায় বের হতে পারলেও তার দুটি পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর হুইল চেয়ার সঙ্গী হয়েছে তার। এরপর আর কোনো উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হতে পারেননি। সিআরপিতে চিকিৎসা নিতে এসে পরিচয় হয়েছিল এখানকার কর্মী খোকন মিয়ার সঙ্গে। পরে সিআরপিতেই তাদের বিয়ে হয়।এখন তারা তিন ছেলে-মেয়ের বাবা-মা। থাকেন সাভারের গণকবাড়িতে সিআরপির কর্মীদের আবাসিক এলাকায়।

তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর ১৫ লাখ টাকা এককালীন পেয়েছিলেন ক্ষতিপূরণ হিসেবে। দীর্ঘ চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাকে। পায়ের যে অংশ কেটে ফেলা হয়েছে সেখানে এখনো তীব্র ব্যথা হয়। এখন আর হাসপাতালে যেতে পারেন না। কারণ তিনি গণপরিবহন ব্যবহার করতে পারেন না।তাই অনেকদিন গ্রামের বাড়ি পাবনাতেও যাওয়া হয় না। স্বামীর সামান্য আয়েই চলছে সংসার, বলেন রেহানা।নজরুল ইসলাম কাজ করতেন রানা প্লাজার আট তলায়। ভবনটি ধসের পর দুপুর ১টার দিকে তাকে বের করে আনেন উদ্ধারকর্মীরা। তার মেরুদণ্ড ভেঙেছিল। প্রায় চার মাস হাসপাতালে ছিলেন। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে অস্ত্রপচার হয়, পরে সিআরপিতে দীর্ঘদিন থেরাপি নেন। এখন হাঁটতে পারেন তবে খুব ধীরে ধীরে। কিন্তু কোনো ভারী কাজ করতে পারেন না।

নজরুল বলেন, সিআরপি থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে সাভারের আড়পাড়ায় একটি মুদি দোকান করে দেওয়া হয়েছিল। সেটা দিয়েই সংসার চলছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখনো প্রায়ই কোমরসহ শরীরের নিম্নাংশে তীব্র ব্যথা হয়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়েবেটিসও আছে।আরেক শ্রমিক আবু বকর সিদ্দিকও রানা প্লাজার আট তলায় নিউ ওয়েব স্টাইল কারখানায় কাজ করতেন। ভবন ধসের প্রায় ১০ ঘণ্টা পর উদ্ধারকারীরা তাকে বের করে আনেন। কোমরে ও মাথায় আঘাত পেয়ছিলেন তিনি, ডান কানের পর্দা ফেটে যায়। চিকিৎসা নিতে হয়েছে এক বছরের বেশি। এখনো মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা নিয়ে চলছেন। কিন্তু আর কোনো কাজ করতে পারেননি। দীর্ঘ বেকারত্বের পর ২০১৭ সাল থেকে চায়ের দোকান করছেন।

আহত শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবনের কথা জানেন শ্রমিক সংগঠকরাও।গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, আহত শ্রমিকদের জীবন আসলেই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। যাদের হাত-পা কাটা পড়েছিল তারা এককালীন কিছু টাকা পেয়েছে। কিন্তু অনেকের আঘাত হাত-পা কাটার চেয়ে কম না। যেমন যারা মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন, এদের অনেকেই আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তারা ভারী কাজ তো দূরের কথা, স্বাভাবিক কাজই করতে পারেন না। সারা বছর ওষুধ খেতে হয়।

রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ওই ঘটনার পর থেকে বেকারত্বের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন বা কাটাচ্ছেন। জীবনের তাগিদে হয়তো একটা চাকরি নেন, কিন্তু বেশিদিন সেটা কন্টিনিউ করতে পারেন না।এই শ্রমিক নেত্রী বলেন, তাদের জন্য আমরা আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী সারা জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলাম। তখন কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা হয়েছিল। আমরা দেখলাম সেখান থেকে একটা অংশ শ্রমিকদের দেওয়া হয়। আমরা দাবি করি স্থায়ী পঙ্গু শ্রমিক, কাজ করতে অক্ষম শ্রমিকদের পুনর্বাসনের।

প্রথমদিকে তাদের অনেকে সহায়তা পেয়েছে। এরপর আর কোনো সহায়তা পায়নি। তারা আসলে ভারী কাজ করার অবস্থায় নেই। ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে বিষয়টা ভয়াবহ অবস্থায় চলে গেছে। আমরা রানা প্লাজার খালি জমিটা নিহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য কাজে লাগানোর কথা বলেছিলাম। সেটাও করা হচ্ছে না। আমরা বলছি তাদের জন্য কিছু করুন যেন বাকী জীবনটা তারা কাটাতে পারে, এভাবে যেন তাদের ধুঁকতে না হয়।রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন্স কারখানার দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে গঠিত রানা প্লাজা ক্লেইমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং তাজরীন ক্লেইমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সমন্বয়করা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে বেঁচে যাওয়া ১১ লাখ ডলার ও সাড়ে তিন লাখ ইউরো দিয়ে ২০১৬ সালে শ্রমিকদের দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করে।

‘রানা প্লাজা ও তাজনীর ফ্যাশন্স কারখানার দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা সহায়তা ট্রাস্টের (টিআইডব্লিউএমসি) অফিস ও সেবাকেন্দ্র সাভারের ভেলরি টেইলর সড়কের (সিআরপি রোড) ডগরমোড়ায়।এই ট্রাস্টের সমন্বয়ক এম শাহরিয়ার রনি বলেন, তাদের কেন্দ্রে রানা প্লাজা ধসে আহত এক হাজার ৯৮৬ জন শ্রমিক নিবন্ধন করেছেন এবং চিকিৎসা নিচ্ছেন। এসব শ্রমিকদের একটা বড় অংশ তাদের আঘাতের কারণে দুর্ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন সময় বেকার থেকেছেন।নিবন্ধিত এসব শ্রমিকদের মধ্যে তিন থেকে সাড়ে তিনশ জন এই মুহূর্তে বেকার বলে তথ্য দিয়েছেন তিনি।

এই কেন্দ্রে একজন মেডিকেল অফিসার নিয়মিত শ্রমিকদের চিকিৎসা দেন। পাশপাশি খণ্ডকালীন একজন ফিজিওথেরাপিস্ট এবং একজন সাইকোথেরাপিস্ট সপ্তাহে তিনদিন সেবা দেন। এখানে আসা বেশিরভাগ শ্রমিকই কোমর, অস্তিসন্ধিসহ বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘমেয়াদী ব্যথায় ভুগছেন। শ্রমিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডায়েবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।কেন্দ্র থেকে তাদেরকে ডাক্তারের পরামর্শ, ওষুধ ও যাতায়াতের খরচ দেওয়া হয়। পাশাপাশি সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতাল, পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি), সাভারের ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিকসহ দুটো ওষুধ ও চশমার দোকানের সঙ্গে কেন্দ্রের চুক্তি রয়েছে। এছাড়া যেকোনো সরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা, ওষুধ ও স্বাস্থ্য সামগ্রী কেনার বিল কেন্দ্রে জমা দিলে সেগুলোও দেওয়া হয়। পাশাপাশি শ্রমিকদের হুইল চেয়ার, ক্র্যাচ, হেয়ারিং এইডের মতো সামগ্রীও সরবরাহ করা হয়।

শাহরিয়ার রনি বলেন, এখানে মানসিক সহায়তা বা সাইকোথেরাপিস্ট থাকলেও আহত শ্রমিকরা তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হন না। কারণ তারা শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত থাকেন বেকারত্ব নিয়ে। তারা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে এবং পারিবারিক সমস্যার সমাধান চান, কিন্তু কেন্দ্র থেকে সেগুলো করা সম্ভব হয় না।দেখা গেছে আহত শ্রমিকদের অনেকেরই সংসার ভেঙে গেছে। ইনজুরির কারণে তারা হয়তো সংসার জীবনে প্রথাগত ভূমিকাগুলো পালন করতে পারছেন না, সে কারণেও সংসারে নানা জটিলতার তৈরি হয়েছে। এসবের সমাধান তো আমরা দিতে পারি না।