সারা দেশ

পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাই নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ঢাবি ছাত্র সোহাগ

দারিদ্রতা মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে সমস্যা সৃষ্টি করে। সেই সমস্যায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইসমাইল হোসেন সোহাগ। যার দাদা-বাবা কারো নামেই কোথাও এক টুকরো জমি নেই। এতে সোহাগ পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাই নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। পড়ালেখা ছেড়ে প্রায় প্রতিমাসেই তাকে বাড়িতে আসতে হয়। দখলে থাকা ৬৯ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত পেতে সরকারি বিভিন্ন দফতরে ঘুরতে হয় তাকে। দাদা-বাবা-চাচা কেউই শিক্ষিত না হওয়ায় প্রতারণার শিকারও হয়েছে পরিবারটি। মাথা গোঁজার ঠাই হিসেবে দখলে থাকা জমিটি বন্দোবস্ত পেতে আকুতি জানিয়েছে সোহাগ।

এদিকে সোহাগদের দখলে থাকা জমিটি প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিবেশী আবুল কালাম ওরপে আবু দালাল তার স্ত্রী, মেয়ে ও মেয়ে জামাইদের নামে বন্দোবস্ত নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। এতে তারা কৌশলে সোহাগদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সকল রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তাদেরকে ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হয়। মানবেতর জীবনযাপন করছে পরিবারটি। সোহাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। তিনিলক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরলরেন্স ইউনিয়নের উত্তর চরলেন্স গ্রামের শ্রমিক শাহ আলমের ছেলে।

সোহাগের দাদা আলী আহম্মদ পাটওয়ারী সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮১ কিংবা ৮২ সালের দিকে উত্তর চরলরেন্স মৌজার ৬৯ শতাংশ খাস জমিতে আলী ঘর করে বসতি গড়ে তোলেন। প্রায় ৪২ বছর ধরেই ওই জমিতেই পরিবার নিয়ে থাকছেন। নিরক্ষর এ ব্যক্তি উত্তর চরলরেন্স গ্রামের বিলাত আলী বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন। তার নামে কোথাও কোন জমি না থাকায় তিনি খাস জমিতে উঠে আসেন। নিরক্ষর আলী পেশায় কৃষি শ্রমিক ছিলেন। সেখানে বসবাস করার কয়েক বছর পর জমিটি বন্দোবস্ত নিতে তিনি স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করেন। তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় স্থানীয় জয়নাল মেম্বার বাড়ির বাসিন্দা আবুল কালামের সঙ্গে।

আলী তাকে ঘটনাটি বলে। এতে আবু তাকে জমি বন্দোবস্ত পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। অক্ষর জ্ঞান না থাকায় তিনি আবু কথা বিশ্বাস করে। আর জমি পেতে হলে ১ লাখ টাকা খরচ দিতে হবেও বলে জানায় আবু। তখন স্থানীয় গণ্যমান্যদের উপস্থিতিইে আবুকে তিনি ৮০ হাজার টাকা দেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় আরও টাকা দেওয়া হয় তাকে।এদিকে কৌশলে আলীর বসতবাড়ির আশপাশের খাসজমিগুলো আবু দখলে নেয়। যদিও তার নামে অন্য স্থানে জমি ছিল। এরমধ্যে কিছুদিন পরই আলীর নামে জমি বন্দোবস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু কখনো তাকে কোন কাগজপত্র দেওয়া হয়নি। নানান তালবাহানা করে সময়ক্ষেপন করে আবু। প্রায় ৭ বছর আগে আবু হজ¦ করতে যান।

সেখান থেকে ফিরেই দলিল বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তা দেননি আবু। এরমধ্যেই স্থানীয়ভাবে শোনা যায় আবু তার স্ত্রী, ৩ মেয়ে ও ৩ মেয়ে জামাইসহ ৮ জনের নামে চারটি পৃথক নথিতে ১৯৫ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত নেয়। তবে আলীর নামে কোন জমি নেওয়া হয়নি। বিষয়টি জানতে পেরে আলী তার নাতি সোহাগকে সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কাগজপত্র উত্তোলন করে। এতে দেখা যায় আলীর দখলে থাকা জমিটিও আবু তাদের নামে নথিভূক্ত করে নিয়েছে।আলী আহম্মদ পাটওয়ারী বলেন, ৪২ বছর ধরে আমি ৬৯ শতাংশ জমিতে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছি। গাছপালাগুলোও আমার হাতে লাগানো। কিন্তু আবু আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ২০২২ সালে আবু মারা যান।

তখন জানাযার আগে তার বড় মেয়ের জামাই ইসমাইল হোসেন স্থানীয় গণমান্যদের উপস্থিতিতে আমার দখলে থাকা জমিটি আমাকে দিয়ে দেবে বলেছে। এখন উল্টো আমাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সকল রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আমাদেরকে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।ইসমাইল হোসেন সোহাগ বলেন, আবু মিয়াদের নামে করা নথি বাতিলে আবেদন করা হয়। এনিয়ে গত ১৩ মার্চ ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তার দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনও আমাদের পক্ষেই এসেছে। এর বিরুদ্ধে আবুর মেয়ে জামাই ইসমাইলসহ অন্যরা ‘টাকার বিনিময়ে’ সার্ভেয়ারকে এনে একটি প্রতিবেদন তাদের পক্ষে করে নেয়। ৭ নভেম্বর আমরা ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি। বন্দোবস্ত দেওয়া পূর্বের নথিটি বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসেই আমাকে বাড়িতে আসতে হয়। এতে আমার পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। দখলে থাকা ৬৯ শতাংশ সরকারি খাস জমিই আমাদের শেষ আশ্রয় স্থল। দয়া করে আমাদেরকে এ জমিটি বন্দোবন্ত দিতে সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।তোরাবগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী শাহ আলম বেপারী বলেন, জমি বন্দোবস্ত নিয়ে আলী ও আবুর বিষয়টি আমি শুরু থেকে প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আলী সকল টাকা আমার মাধ্যমেই আবুকে দিয়েছেন। শুধু ৮০ হাজার টাকা নয়, আবু বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে আরও বেশি টাকা নিয়েছেন।জানা গেছে, আবুল কালাম নিজের নামসহ তার স্ত্রী শাহিনুর বেগম, মেয়ে কামরুন নাহার, সামছুন নাহার সুমি, নুর নাহার লিপি ও তিন মেয়ের জামাই ইসমাইল হোসেন, আবুল হাসনাত খোকন ও আবুল বাশার।জানতে চাইলে আবুর মেয়ের জামাই ইসমাইল হোসেন বলেন, জমিটি আমার শ্বশুরের।

তিনি জমিটি আমাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছেন। আলীকে মানবিক দৃষ্টিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি অন্যত্র যাচ্ছেন না। উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আসছেন। তাদের কোন জমি নেই। আমার শুাশুড়ি ও শালিকা ঘরে একা থাকেন। রাতের অন্ধকারে দূর্বৃত্তরা জানালায় ইট-পাটকেল ছোঁড়ে। বিভিন্ন ধরণের চিঠি রেখে যায় বাসার সামনে। ধারণা করা হচ্ছে জমিকে কেন্দ্র করেই ঘটনাটি ঘটছে।চরলরেন্স ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন মাষ্টার বলেন, জমি দেওয়ার কথা বলেই আলীকে আবু দখলে বসায়। এরপর আবু তাকে ৫ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল এখান থেকে সরে জন্য।

কিন্তু আলী তাতে রাজি নয়। আলী হয়তো আবুকে টাকা-পয়সা দিয়েছিল, কিন্তু টাকার বিষয়ে কখনো আলোচনায় আসেনি। তবে জমি আবু তার স্ত্রী-মেয়ে ও মেয়ে জামাইদের নামেই বন্দোবস্ত নিয়েছে।চরলরেন্স ইউনিয়ন উপ-সহকারী ভূমি কমকর্তা জাফর আকবর হোসাইন বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। ঘটনাটি আমার জানা নেই। শুনেছি আমার আগের কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে পরিবারটিকে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

বক্তব্য জানতে উপজেলা সার্ভেয়ার প্রমেশ্বর চাকমাকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, ঘটনাটি আমার জানা আছে। আমি সোহাগদেরকে এসিল্যান্ডের সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলাম। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হবে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক প্রতিবেদন দেওয়া হবে। আমাদের পক্ষ থেকে সকল ধরণের সহযোগীতা করা হবে।