জাতীয়

রাসেলস ভাইপার নিয়ে ২৭ জেলায় আতঙ্ক সচেতন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

গত মাসের শুরু থেকে দেশে অন্যতম আলোচিত বিষয় রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ। এ পর্যন্ত দেশে ২৭টি জেলায় উপস্থিতি শনাক্ত হওয়া সাপটি যতটা না ভয়ঙ্কর তারও অধিক ছড়িয়েছে আতঙ্ক। দিনকে দিন সাপটি নিয়ে বাড়ছে গুজবের ডালপালা। ফলে রাসেলস ভাইপারসহ সাপের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধে নেমেছে সাধারণ মানুষ। নির্বিচারে হত্যার শিকার হচ্ছে সাপের বিভিন্ন নিরীহ প্রজাতিও। সাপ হত্যা করলে পুরস্কারের মিথ্যা ঘোষণাও প্রচার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সাপ বাস্তুসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উল্লেখ করে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।রাসেলস ভাইপার এ দেশে চন্দ্রবোড়া, বোড়া বা উলুবোড়া ইত্যাদি নামে পরিচিত।

শত শত বছর ধরেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর উপস্থিতি ছিল। তবে কয়েক দশক আগে সাপটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন, বসবাসযোগ্য পরিবেশ ও খাদ্যের যোগান থাকায় রাসেলস ভাইপার নতুন করে দেখা দিয়েছে। খুবই দ্রুত বেশ কয়েকটি জেলায় ছড়িয়েও পড়েছে। এ নিয়ে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ার একাংশে বিভ্রান্তিকর ও ভীতি ছড়ানোর মতো তথ্য ছড়াচ্ছে। এতে আতঙ্কের মাত্রা চরমে উঠেছে। এ সাপ তেড়ে এসে মানুষকে কামড় দেয়, ৬০-৭০টি বাচ্চা একসাথে দেয় এবং এর প্রতিষেধক নেই বলেও প্রচার করা হচ্ছে।যদিও এর সবই গুজব বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এক সচেতনতামূলক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, মানুষের সঙ্গে রাসেলস ভাইপারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। সাপটি সাধারণত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোপ-জঙ্গল, উন্মুক্ত বন ও কৃষি এলাকায় বাস করে এবং জনবসতি এড়িয়ে চলে। মেটে রঙের হওয়ায় সাপটি মাটির সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারে। লোকে খেয়াল না করে খুব কাছে গেলে সাপটি নিজেই ভয় পেয়ে আক্রমণ করে।মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে সাপটি দেখা যাওয়া এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড় ও কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্ষেত বা ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকায় কাজ করার সময় বুট ও লম্বা প্যান্ট পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া রাতে অন্ধকার স্থানে চলাচলের সময় টর্চলাইট ব্যবহার করা, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, পড়ে থাকা গাছ, লাকড়ি বা খড় সরানোর সময় সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। সাপ দেখলে ধরা বা মারার চেষ্টা না করে প্রয়োজনে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে কল করতে বা কাছের বন বিভাগ কার্যালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।অপরদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে সাপটির এন্টিভেনমের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। ইতোমধ্যে আক্রান্ত এলাকার সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এটি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সাপটির দংশনের শিকার শতকরা ৭০ ভাগ রোগী চিকিৎসায় বেঁচে থাকেন। অপরদিকে মৃত্যুবরণ করা ৩০ শতাংশের বেশিরভাগই ওঝাসহ নানা স্থানে চিকিৎসা গ্রহণ করে দেরিতে হাসপাতালে আসা ও না আসায় মারা যান।

এ অবস্থায় আগ বাড়িয়ে সাপ মারার চেষ্টা করা বিপজ্জনক জানিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।দেশেই রয়েছে কার্যকর চিকিৎসা দীর্ঘদিন দেশের সাপ ও এর বিষ নিয়ে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) জেনেটিকস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু রেজা। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, দেশের ২৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপার পাওয়া গেছে। এর মানে এই নয় যে মানুষ ঘর থেকে বের হবে না। বলা হচ্ছে এই সাপ তেড়ে এসে মানুষকে কামড়ায়। অথচ ব্ল্যাক মাম্বা ছাড়া পৃথিবীর কোনো সাপ নিজে থেকে তেড়ে এসে কামড়ায় না। অর্থাৎ ভুলে পা না দিলে বা সাপটি ঝুঁকি না মনে করলে আপনাকে কামড়াবে না। এটা পৃথিবীর দশ বিষধর সাপের তালিকাতেও নেই।

দেশে চিকিৎসা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাসেলস ভাইপারের এন্টিভেনম কাজ করে না, এই তথ্যটি সঠিক নয়। বাংলাদেশে এর চিকিৎসা রয়েছে। শতকরা ৭০ শতাংশ রোগী বেঁচে থাকেন। ভারত থেকে বাংলাদেশে এ সাপের এন্টিভেনম আসে। বিভিন্ন দেশে পাওয়া সাপের বিষের কম্পোজিশন আলাদা আলাদা হয়। ফলে অন্য দেশে উৎপাদিত এন্টিভেনমের কার্যকারিতা কম হতে পারে। এই সাপের বিষে ৫০ ধরণের প্রোটিন থাকে। যা আলাদা আলাদা অঙ্গকে আক্রমণ করে। তাই দেশে এই সাপের এন্টিভেনম উৎপাদন করা গেলে তা অধিক কার্যকরী হবে। এই প্রচেষ্টা চলমান আছে।মৃত্যু বাড়ার কারণ চিকিৎসকের কাছে না আসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং সাপের কামড় ক্লিনিকের দায়িত্বরত ডা. আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৯২০ সালে মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার কামড়। এর পরের প্রায় ১০০ বছর রাসেলস ভাইপারের কামড়ের তথ্য পাওয়া যায়নি।

২০১৩ সালে রাজশালী মেডিকেলে ফের এ সাপের কামড় নিয়ে রোগী ভর্তি হয়। ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ২৩৫ জন রোগী সাপটির কামড়ে রামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ রোগী ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার।এসব রোগীর বেশিরভাগই দেরীতে হাসপাতালে এসেছে। রামেক হাসপাতালে আসা রোগীদের ৬৬ দশমিক ৯০ শতাংশ রোগী ওঝার কাছে যায়। পরবর্তীতে হাসপাতালে এসেছে। আর ৩৩ দশমিক ১০ শতাংশ সরাসরি হাসপাতালে এসেছিল।দেরীতে হাসপাতালে আসায় রাসেল ভাইপারের কামড় খাওয়া ৬০ শতাংশ রোগীর মধ্যে একিউট কিডনি ইনজুরি দেখা যায়। তাদের মধ্যে ১৯ শতাংশ রোগীর ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়।

মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউরের কারণে ১৬ শতাংশ রোগীর ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। আর এসব কারণে ৩০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু ঘটেছে।স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ও মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, সাপের কামড়ে মৃত্যু রোধে ওঝা তান্ত্রিকদের অপচিকিৎসার বিষয়ে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সাপের কামড় ঘটে গ্রামে অথচ চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে শহরে। এটি দূর করতে হবে।সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা সারাদেশে ১৩ হাজারের উপর এন্টিভেনম ডিস্ট্রিবিউশন করেছি। এসব এন্টিভেনম ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আমাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক এন্টিভেনম রয়েছে। প্রয়োজনে আরো আমদানি করা হবে।

এ সময় দেশে এত এত ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি থাকার পরেও তারা কেন দেশেই এন্টিভেনম উৎপাদন করছেন না, তা প্রশ্নের বিষয় বলেও মন্তব্য করেন এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ও মেডিসিন বিষয়ের অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, বছরে যত লোক সাপের কামড় খায় এর মধ্যে প্রতি ৬০ জনে মাত্র একজনের মৃত্যু হয়। কারণ আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাপ নির্বিষ। বৈশ্বিক হিসেবও তাই। এ দেশে সাপের কামড়ে যারা মারা যায় তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই সাত-আট ঘণ্টা পর হাসপাতালে আসে। এ কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হয়।

তবে হাসপাতালে নেওয়া ৭০ শতাংশের বেশি রোগী ভালো হয়ে যায়।এদিকে বন্য প্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপ মানুষের জন্য উপকারী। এরা ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া এই সাপের বিষ থেকে অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়। এর বিষ খুব দামিও। তাই রাসেলস ভাইপারসহ কোনো ধরনের সাপই হত্যা করা উচিত নয়। এটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধও।