13 February 2024 , 4:58:54 প্রিন্ট সংস্করণ
তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের চার দিন পরও পাকিস্তানিরা জানেন না কোন দল তাদের পরবর্তী সরকার গঠন করবে কিংবা পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কারাবন্দি এবং তার রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) নির্বাচনে নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও দলটির সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জাতীয় পরিষদের ৯৩টি আসনে জয় পেয়েছেন। পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী এই ফল পর্যবেক্ষকদেরও অবাক করেছে।
তারপরও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৬৯ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার তুলনায় পিটিআইয়ের এই আসন অনেক কম।দেশটির আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৫টি আসনে জয় পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তার প্রতি দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল এবং পাকিস্তান ছেড়ে লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে আসা তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীই জয়ী হতে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪টি আসনে জয় পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। পাকিস্তানের সংবিধানে বলা আছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারি অথবা নির্বাচনের দিন থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সরকার গঠন করতে হবে। দেশটির জাতীয় পরিষদে মোট ৩৩৬টি আসন রয়েছে। যার মধ্যে ২৬৬টি আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। এ ছাড়া জাতীয় পরিষদে ৭০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে।
এর মধ্যে ৬০টি নারীদের এবং ১০টি অমুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত। জাতীয় পরিষদে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অনুযায়ী এসব আসন বণ্টন করা হয়।দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকার ইসলামাবাদ থেকে বিবিসির উর্দুকে বলেছেন, ‘‘এটা একটি ভঙ্গুর ম্যান্ডেট; যেখানে কোনও দলেরই সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তারপরও নিজেদের অস্তিত্বের জন্য দলগুলোকে সমাধান খুঁজতে কিংবা একটি জোট গঠন করতে হবে।যদিও ইমরান খানের পিটিআই ও নওয়াজের পিএমএল-এন— উভয় দলই বিজয় ঘোষণা করেছে। যে কারণে দেশটিতে একটি জোট সরকার অনিবার্য বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক সংকট অব্যাহত থাকায় নির্বাচনে হেরে যাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট কারচুপির অভিযোগে আদালতে একের পর এক অভিযোগ দায়ের করেছেন। পিটিআইয়ের সমর্থকরাও সারাদেশে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন।অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা ইয়াসমিন বিবিসির নিউজডে অনুষ্ঠানে বলেছেন, সম্ভাব্য এক দৃশ্যকল্পে পিপিপির পাশাপাশি কিছু ছোট দলের সাথে জোট গঠন করতে পারে পিএমএল-এন। এই দুটি দল ২০২২ সালে জোট গঠন করে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ ও গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তান শাসন করেছে।
তিনি বলেন, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এবং প্রেসিডেন্ট পদের ভাগাভাগি কীভাবে হবে সেটিই হতে পারে দল দুটির প্রধান বিতর্কের বিষয়। তবে বিভিন্ন প্রদেশেও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে একই ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।দেশটির সামাজিক উদারপন্থী রাজনৈতিক দল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টকেও (এমকিউএম) জোটে টানার লড়াই করছে পিএমএল-এন। এবারের নির্বাচনে এমকিউএম ১৭টি আসনে জয় পেয়েছে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে পিএমএল-এন।রোববার লাহোরে নওয়াজ শরিফের ভাই শেহবাজের নেতৃত্বে পিএমএল-এনের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করেছেন পিপিপির কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলি জারদারি।
জোট সরকার গঠনে পিএমএল-এনের প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য পিপিপি সময় নিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সোমবার ইসলামাবাদে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।পিটিআইয়ের সাথে পিপিপি কাজ করতে ইচ্ছুক কি না, বিবিসি উর্দুর এমন এক প্রশ্নের জবাবে পিপিপির জ্যেষ্ঠ নেতা শেরি রেহমান বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলের জন্য পিপিপির দরজা উন্মুক্ত রয়েছে।তবে ইমরান খানের গণমাধ্যমবিষয়ক উপদেষ্টা জুলফি বুখারি বিবিসিকে বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে জোট গঠনের পরিবর্তে সংসদে বিরোধী দলীয় বেঞ্চে বসার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে পিটিআইয়ের।
ইমরান খানও এর আগে একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন; যিনি বর্তমানে বিভিন্ন অভিযোগে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের সাজা ভোগ করছেন। ২০১৮ সালে ইমরান খান বলেছিলেন, জোট সরকার গঠন করা হলে তা অত্যন্ত দুর্বল হবে এবং দেশ যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে শক্তিশালী সরকারের প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও তিনি এমকিউএমের মতো ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করতে চেয়েছিলেন।পিএমএল-এনের সাথে পিটিআইয়ের জোট গঠন করা হলে তা হবে রীতিমতো অবাক করার মতো বিষয়। রাজনীতিতে এই পথ পরিবর্তন অকল্পনীয়, তবে অসম্ভব নয়।
পিটিআইয়ের প্রধান ইমরান খানকে কারাগারে প্রেরণ, তার দলের প্রতীক কেড়ে নেওয়া এবং অসংখ্য সমর্থককে আটকও করা হয়েছে পিএমএল-এনের সরকারের আমলে।তবে নজিরবিহীন এই সময়ে কোনও কিছুর সম্ভাবনাই নাকচ করা যায় না।পিএমএল-এনের জ্যেষ্ঠ নেতা আজম নাজির তারার একটি ‘‘অংশগ্রহণমূলক জোট সরকার’’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। যেখানে সবার হাত মেলানো উচিত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, পিটিআইকে উপেক্ষা করা যাবে না।
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির উদয় চন্দ্র বিবিসিকে বলেন, ‘‘এমনকি যারা আগে ইমরানকে ভোট দেয়নি তারাও গত দুই বছরে সেনাবাহিনী ইমরান খান ও তার দলের সাথে যে আচরণ করেছে তা অবিচারসুলভ বলে মনে করতে পারেন। তারা এই অঞ্চলজুড়ে সাধারণ গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যের অনুভূতিকে লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মনে করতে পারেন।তিনি বলেন, স্বতন্ত্রদের নির্বাচিত করার মাধ্যমে ভোটাররা সেনাবাহিনীর কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে যে, জনগণের গণতন্ত্রের জয় হোক।
• পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্রদের ছোট দলে যোগদান
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সম্ভাব্য আরও এক মেরুকরণ দেখা যেতে পারে। যেখানে পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জোট সরকার গঠনের জন্য একটি ছোট দলে যোগ দিতে পারেন। পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্রদের সব আসনকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা এবং নারীদের জন্য জাতীয় পরিষদের সংরক্ষিত ৬০টি আসনকে পুঁজি বানানোর জন্য এটা করা হতে পারে।
নির্বাচনে জয় পাওয়া প্রতি ৩ দশমিক ৫ আসনের বিপরীতে সংরক্ষিত একটি আসনের বরাদ্দ পায় একটি রাজনৈতিক দল। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোনও দলের না হওয়ায় তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বরাদ্দ নেই। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল ঘোষণার সময় থেকে ৭২ ঘণ্টার মাঝে স্বতন্ত্রদের অবশ্যই নিবন্ধিত কোনও রাজনৈতিক দলে যোগদান অথবা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে বসার ঘোষণা দিতে হবে।
লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের অধ্যাপক আসমা ফয়েজ বলেন, পিটিআইয়ের জোট সরকার গঠন করতে পারবে, এমন সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। কারণ ছোট দলগুলোর সাথে জোট করলেও তারা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না।