জাতীয়

বিএনপি কর্মীরা আটক নির্দিষ্ট অভিযোগে বললেন আইনমন্ত্রী আনিসুল

সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরে (ওএইচসিএইচআর) সোমবার (১৩ নভেম্বর) মানবাধিকার পর্যালোচনাসংক্রান্ত চতুর্থ ‘ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ (ইউপিআর)’ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এতে অংশ নেয়। এ সময় খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্যাতনের নানা অভিযোগ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন তিনি। এ ছাড়া অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের উদ্দেশে তিনটি সুপারিশ তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্র।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার তার সংবিধান অনুযায়ী জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এজন্য নির্বাচন কমিশন যাতে স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।’ এ সময় বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সম্পর্কে আনিসুল হক বলেন, ‘এটি অসাংবিধানিক ও অবৈধ। জেনেভায় খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়েও কথা বলেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। এখন তার পছন্দ অনুযায়ী বাংলাদেশে তার চিকিৎসা হচ্ছে। দেশের আইনে সাজাপ্রাপ্ত আসামির চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই।

আইনমন্ত্রী বিএনপির ‘যাবতীয় সহিংস কার্যক্রমের’ ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমরা দেখছি বিএনপির কর্মীরা সহিংসতা ছড়াচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে নিরপরাধ ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্কুলকে সহিংস হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, দলটির কর্মীদের নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক সুযোগের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। সংসদে বিরোধী দলগুলো সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করেছে।

মন্ত্রী জানান, ২০১৫ সাল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৬৯২টি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮৮ জন পুলিশের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২৪টি মামলা হয়েছে। মতপ্রকাশের পরিবেশের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী। ৩৯টি টিভি চ্যানেল, ৫৭৬টি সংবাদপত্র ও ১৮২টা অনলাইন সংবাদমাধ্যম রয়েছে। ২ হাজার ৩২৮টি দেশীয় এনজিও ও ২৬৭টি বিদেশি এনজিওর কারও ওপর কোনো সেন্সরশিপ নেই।গতকালের আগে বাংলাদেশ আরও তিনবার এ অধিবেশনে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় মুখোমুখি হয়। প্রথমবার ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি তুলে ধরা হয়। এরপর ২০১৩ সালের এপ্রিলে এবং ২০১৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরে।

ইউপিআরে ৪৭ সদস্য দেশের অংশগ্রহণ থাকে যেখানে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশ যার যার মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবনার আলোকে ইউপিআর গঠিত হয়। গতকালের ইউপিআর অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে আসা সুপারিশগুলো হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা, মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সব নাগরিকের জন্য অবাধ ও স্বাধীন বিচার নিশ্চিত করা।

ইউপিআর অধিবেশনে এর আগে ওএইচসিএইচআর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটছে অভিযোগ করে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ বিবৃতির পর কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার এবং মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিসহ নানা পক্ষ থেকে নিজ নিজ সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বলপ্রয়োগের আওতা সীমিত করতে আইন সংশোধন করা, মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিস্তৃত তদন্ত করা এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশেষ করে, কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার বাংলাদেশের প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম তদারকি কার্যক্রম যতেœর সঙ্গে করা এবং মৃত্যুদ- আরোপ হতে পরে এমন আইনের প্রয়োগ নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানায়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানায়, তারা যেন আটক বা গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বন্দি রাখার স্বীকৃতি স্থানের তালিকা প্রকাশ করে, বিশেষ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে গুম নিষিদ্ধ করে এবং জোরপূর্বক গুম প্রতিরোধে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুমোদন করে।জেনেভায় আনিসুল হকের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, জেনেভায় জাতিসংঘের বাংলাদেশ অফিসের প্রতিনিধি মোহাম্মদ সুফিউর রহমান এবং অন্যরা। আনিসুল হক তার অবস্থান তুলে ধরে বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও তিনি জোরালো বার্তা দেন।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উত্থাপিত ইস্যুগুলোর মধ্যে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা, যা এরই মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে পরিণত হয়েছে। এ আইনের আওতায় ঝুলে থাকা সব মামলা খতিয়ে দেখতে একটি স্বাধীন বিচারিক প্যানেল প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। নাগরিক অধিকার সংকোচন, ভীতি প্রদর্শন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের কথা তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এবং আরও অন্যান্য সংগঠনের বিরুদ্ধে সব হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।মানবাধিকার হাইকমিশনের উদ্ধৃতিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, জোরপূর্বক গুমের মতো ঘটনাগুলো অব্যাহত থাকার পেছনে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কর্তৃক রক্ষাকবচের ঘাটতি রয়েছে।

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিবার ও নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে একটি স্বাধীন ও বিশেষায়িত কাঠামো গঠন করার আহ্বান জানানো হয়।কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে অভিজাত বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র‌্যাব) অন্যান্য সংগঠনের নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে এ ক্ষেত্রেও একটি স্বাধীন কাঠামো গঠনের আহ্বান জানানো হয়।