আন্তর্জাতিক

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনে কী ঘটছে

ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গত শনিবার কয়েক দশকের মধ্যে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পড়ে হামাস যোদ্ধাদের এই হামলায় অনেক ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। অনেকে জিম্মিও হয়েছে যোদ্ধাদের হাতে।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণ গেছে অন্তত ১১ শ’ মানুষের। কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হল? হামাস-ইসরায়েল কেন লড়ছে? ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণেই কী সেখানে এত বড় হামলা? – দেখা দিয়েছে এমন নানা প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

হামাস কি?

হামাস ফিলিস্তিনের একটি ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের দল। গাজার শাসনক্ষমতায় রয়েছে দলটি। ইসরায়েলকে ধ্বংসের শপথ নিয়েছে হামাস। ২০০৭ সালে গাজার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েকটি যুদ্ধ লড়েছে দলটি।

পাল্টা জবাবে ইসরায়েলও হামাসের ওপর বারবার বিমান হামলা চালিয়েছে। মিশরের সঙ্গে একযোগে ২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকাকে করে রেখেছে অবরুদ্ধ। কারণ, হিসাবে গাজার নিরাপত্তা রক্ষার দোহাই দিয়েছে ইসরায়েল।

সামগ্রিকভাবে হামাসকে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দলের সশস্ত্র শাখাকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ তকমা দিয়েছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলো।হামাসকে সমর্থন দিয়ে আসছে ইরান। দেশটি হামাসকে অর্থায়ন করাসহ তাদেরকে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে।

গাজা উপত্যকা কী?

ইসরায়েল, মিশর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যকার ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত এক ভূখণ্ড গাজা উপত্যকা। সেখানে প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বাস। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি এই উপত্যকা।

গাজার আকাশসীমা এবং উপকূলরেখা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে আছে। সীমান্ত দিয়ে কোন কোন পণ্য গাজায় ঢুকবে কিংবা বের হবে তার ওপরও আছে ইসরায়েলের কড়াকড়ি। একইভাবে মিশরও তাদের গাজা সীমান্তে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।

ফিলিস্তিন কী?

জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর ও গাজা মিলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড হিসাবে পরিচিত। আবার পূর্ব জেরুজালেম এবং ইসরায়েল সবই সেই রোমান যুগ থেকে ফিলিস্তিন হিসাবে পরিচিত ভূখণ্ডের অংশ। এ ভূখণ্ড মুসলিমসহ ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের মানুষের কাছেও পবিত্র এবং আদি জন্মভূমি হিসেবে বিবেচিত।

১৯৪৮ সালের ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। যদিও এ ভূখণ্ডকে এখনও ফিলিস্তিন বলেই মানেন সেই সব মানুষেরা, যারা ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন না।আর ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম তীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুজালেমকে একযোগে একটি শব্দে বোঝাতে ফিলিস্তিন নামটি ব্যবহার করে।

হামাস-ইসরায়েল লড়ছে কেন?

ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার দিনটি ছিল ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি সেদিন ইসরায়েলে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। সেখান থেকেই সূচনা।ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরায়েলে হাজার হাজার রকেট হামলা চালানোর পাশাপাশি স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথ ব্যবহার করে সুপরিকল্পিতভাবে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে পড়ে।

তারা কয়েক ঘণ্টা ইসরায়েলি শহর ও সেনাচৌকি অবরুদ্ধ করে রাখে। অভিযানে বেশ কিছু ইসরায়েলি নিহত হয়। অন্তত ১০০ ইসরায়েলি নাগরিককে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা।

এরপরই ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলা শুরু করে। সেখনে বিভিন্ন স্থানে হামাস যোদ্ধাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে বলে জানায় তারা। হামাস এবং ইসরায়েলের এই পাল্টাপাল্টি হামলায় সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি।

হামাসের হামলা কতটা নজিরবিহীন ছিল?

বিবিসির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন লিখেছেন, হামলাটি ছিল গাজা থেকে হামাসের চালানো সবচেয়ে সুপরিকল্পিত এক সফল অভিযান। সীমান্ত পেরিয়ে হামাস যোদ্ধাদের সবচেয়ে মারাত্মক হামলা ছিল এটি। এক প্রজন্মের বেশি সময়ের মধ্যে ইসরায়েল এমন হামলার মুখে পড়েনি।বহু জায়গায় গাজা থেকে ইসরায়েলকে আলাদা করা তারের বেড়া ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে হামাস যোদ্ধারা।

৫০ বছর আগে ইসরায়েলে মিসর ও সিরিয়ার আকস্মিক হামলার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধেরই বর্ষপূর্তির পরদিন ঘটেছে এই নজিরবিহীন হামলা। হামাস নেতাদের কাছে সেই দিনের গুরুত্ব হারিয়ে যাবে না।

ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা?

বিবিসি-র নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার এর উত্তরে বলেছেন হ্যাঁ। তার মতে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেট, গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, এর বহির্মুখী গুপ্তচর সংস্থা এমনকী ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর যত কিছু আছে- সব মিলেও হামলার হুমকি আঁচ করতে পারেনি কিংবা তারা কোনো সতর্কবার্তা পেয়ে থাকলেও ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি বিস্ময়কর বলেই মন্তব্য করেছেন তিনি।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম অনেকটা বিস্তৃত। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন গেরিলা গোষ্ঠীর পাশাপাশি লেবানন, সিরিয়া এবং অন্য আরও জায়গায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার চর ও তথ্যদাতা রয়েছে।মাঠ পর্যায়ে গাজা এবং ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্ত এলাকার বেষ্টনী বরাবর জায়গায় জায়গায় লাগানো আছে ক্যামেরা, গ্রাউন্ড-মোশন সেন্সর এবং সেসব জায়গায় নিয়মিত সেনা প্রহরারও ব্যবস্থা আছে।

ওপরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া বেষ্টনী মানুষের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে যথেষ্ট কার্যকর বলেই মনে করা হয়; বিশেষত, যে ধরনের অনুপ্রবেশ গত শনিবার ইসরায়েলে হামলার ক্ষেত্রে ঘটেছিল, তেমন ক্ষেত্রে। অথচ হামাস যোদ্ধারা এই বেষ্টনী সহজেই পেরিয়ে গেছে।তারা তার কেটে ফাঁক করে পথ তৈরি করেছে কিংবা সমুদ্রপথে এবং প্যারাশুটের সাহায্যে ইসরায়েলে ঢুকেছে।

ইসরায়েলের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো এখন কী?

দক্ষিণ ইসরায়েলের নিরাপত্তা পুনর্প্রতিষ্ঠা করা: এর মানে হচ্ছে, ওই এলাকায় থেকে যাওয়া হামাস বন্দুকধারীদের নির্মূল করা এবং ইসরায়েল ও গাজার মধ্যকার সীমান্ত বেড়া মেরামত করা।ইসরায়েলে হামাসের হামলা চালানোর সক্ষমতা শেষ করে দেওয়া: এ কাজটি ইসরায়েল কখনো করে উঠতে পারেনি। ইসরায়েল জানে যে জায়গাগুলো এ সপ্তাহান্তে বিমান হামলায় তারা ধ্বংস করেছে, সেগুলো আবার সহজেই গড়ে উঠতে পারে।

এক্ষেত্রে আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে স্থল আক্রমণ শানানো: ইসরায়েলি সেনারা ট্যাংক নিয়ে স্থল অভিযান চালাতে পারে। তবে এতে নিঃসন্দেহেই দুপক্ষে প্রচুর মানুষ হতাহত হবে। আর এ অভিযানে হামাস যে নিঃশেষ হয়ে যাবে, তেমন সম্ভাবনাও নেই।শুরু হওয়া সংঘাত ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো: বিশেষ করে পশ্চিম তীর এবং লেবাননে সংঘাত ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে হবে ইসরায়েলকে। কারণ, হামাসের ডাকে অন্যরা সাড়া দিলে ইসরায়েল সমস্যায় পড়ে যাবে এবং তাদেরকে তিনদিক থেকে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হবে।

ইসরায়েলি জিম্মিদের উদ্ধার করা: হামাসের জিম্মি করা ইসরায়েলিদের উদ্ধার করতে ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনীকে উদ্ধার অভিযান চালানোর বিস্তারিত পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে এমন অভিযানে প্রবল ঝুঁকি আছে। আর আলোচনার মাধ্যমে জিম্মিদের মুক্ত করার চেষ্টা নিলে তাতে মাসের পর মাস এমনকী বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে।

এর পর কী

হামাসের সশস্ত্র গোষ্ঠীর কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরবদের ইসরায়েলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে হামাসের অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম বা এই অঞ্চলের অন্যান্য স্থানের ফিলিস্তিনিরা এই ডাকে সাড়া দেবে কিনা।

ইসরায়েল নিঃসন্দেহে বহু দিক থেকে একটি যুদ্ধের দামামা দেখতে পাচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ যা ঘটতে পারে তা হল, এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে শক্তিশালী লেবানিজ গেরিলা দল হেজবুল্লাহ। রোববার সকালেই হেজবুল্লাহ দক্ষিণ ইসরায়েলে বেশকিছু ক্ষেপণাস্ত্র এবং গোলা ছুড়েছে। যদিও এতে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ব্যাপক সেনাসমবেশের নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি গাজায় মুহুর্মূহু বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল সেখানে স্থল অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।