বিনোদন

গল্প – তাসন

মাহমুদ শরীফ

লম্বা লম্বা কাঠের চলাচলা খড়ি জ্বলছে একনাগাড়ে। ভ্যাটের কড়াইয়ের তলায় দগদগে আগুন। কঠিন তাপে টগবগ করে উৎলাচ্ছে কেমিক্যালের মিশ্রণ। বাষ্প হওয়া ধোঁয়াতেও বিশ্রী দুর্গন্ধ। ধোলাই করা সাদা সুতা বাঁশের আড়ায় ঢুকিয়ে কেমিক্যালের মিশ্রণে চোবানো হচ্ছে বার বার। মুহূর্তেই সাদা সুতার শরীরে ফুটে উঠছে নির্দিষ্ট রং।
এদিকে দুইজন শ্রমিকের শরীরে ঘামের গোসল। ভ্যাটের আগুনের বিরামহীন তাপে শ্যামলা গায়ের রং অনেক আগেই তামাটে হয়ে গেছে। কাচামারা লুঙ্গিটাও ঘামে ভিজে জবজবে। প্রায় দুই যুগ এভাবেই সনাতনী পদ্ধতিতে রংয়ের কাজ করে ওরা। কেমিক্যালের প্রভাবে হাত-পা ধূসর হয়ে গেছে অনেক আগেই। শরীর থেকে রংয়ের বিদঘুটে দুর্গন্ধ বের হলেও এটা তাদের সহ্য হয়ে গেছে। হাত-পা, পোষাক আর শরীরের গন্ধে ওরা যে রং শ্রমিক তা সহজেই বোঝা যায়।
একটু ফুরসৎ। ঘামে স্নাত শরীরে রোদে যেয়ে দাঁড়ায় এক শ্রমিক। চৈত্রের দুপুরে কাঠফাটা রোদে ঘাম শুকায় ওর। শ্রমিক মজনু মিয়া যেন একটু শান্তির পরশ পেয়ে বলে উঠে- আহ! কী শান্তি! কী আ-রা-ম!
ব্যবসায়ীক কিছু কথা বলতে গদি ঘর থেকে ছুটে আসে মহাজনের বিশ্বস্থ কর্মচারী মহুরী সরিদ বাবু। এসেই বলে-‘উহ! রোদের কী তাপরে বাপু! কড়া রোদ! আর সহ্য হচ্ছেনা। তাপমাত্রা রেকর্ড ভাংলো মনে হয়। গায়ে যেন ফোঁসকা পড়ে যাবে‘। বলেই ছায়ায় দিকে ছোটে। সিলিং ফ্যানের হাওয়া দরকার জরুরী। ক্রেতা-বিক্রেতাদের দরকশাকশিতে সরগরম হাটের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেয়ে সদি ঘরের নিজের চেয়ারে বসে মহুরী সরিদ বাবু
শ্রমিক মজনু মিয়া বিড়বিড় করে আওড়ায়-কী যে কয় সরিদ দাদা, আমি তো দেখছি রোদেই শান্তি। ভ্যাটের আগুনের কড়া তাপ অসহ্য। ভাল্লাগেনা এই কাজ। কেন যে বাপের দেখানো এই কাজ শিখেছিলাম! জীবনটা তামা তামা হয়ে গেল। বউ কাছে আসতে অসম্মতি জানায়। ছোট্ট ছেলেটাও ‘উঁ-আব্বা তোমার গা গন্ধ‘ বলে দুরে সরে যায়।
ওদিকে শহরের খ্যাতনামা মহাজন সুতা ব্যবসায়ী চৌধুরী সাব্বির হোসেনের মনেও স্বস্তি নেই। ব্যাংকে টিটি জমা করতে হবে। ৫ লাখ টাকার টিটি না পাঠালে নর্দান কটন মিল আগামী সপ্তাহে সুতার ট্রাক পাঠাবেনা। এখনো এক লাখ টাকা দরকার। সাব্বির মহাজনের টেনশন-অস্বস্তি-অশান্তি বেড়েই চলেছে। ব্যাংক টাইম শেষের দিকে প্রায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ^ অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলছে। নতুন করে আবার ফিলিস্তিনিদের উপর বর্বর ইজরাইলের আগ্রাশন বিশ^কে নতুন ভাবে জাগাচ্ছে। বিশ^জুড়ে চলছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। সব কিছুর মত প্রভাব পড়েছে কুমারখালীর বস্ত্রশিল্পের উপরও। বেকায়দায় সলেমানরাও।
লুঙ্গি বিক্রি করে এসে গদি ঘরে ফাঁকা চেয়ারে বসে প্রান্তিক তাঁতী সলেমান শেখ। দশ কিলোমিটার দুরের আমলাবাড়ী থেকে কুমারখালী কাপুড়িয়া হাটে শনি ও মঙ্গলবারে লুঙ্গি বিক্রি করতে আসে সোলেমান। সারা সপ্তাহ স্বামী-স্ত্রী মিলে ১০/১২ থান লুঙ্গি বোনে। এটাই সলেমানের পৈত্রিক পেশা। তাদের পাড়ার অনেকেই পুর্জি হারিয়েছে, দেনা পরিশোধে ভিটেমাটিও হারিয়েছে কেউ কেউ। অনেকেই তাঁত বন্দ করে অন্য পেশা ধরেছে জীবনের তাগিদে। সাতদিন ধরে স্বামী স্ত্রী মিলে বুনানো গ্রে লুঙ্গি বিক্রি না করলে সমস্যা, করলেও সমস্যা। লস আর লস। কী অশান্তি!
‘আর হয় না, জীবন শেষ, কাপড়ের দাম কমে জীবন-সংসার আর চলে না। করোনায় বাঁচলেও এই সলেমান জোলারা এবার শেষ! তাঁতের সব কিছুর দাম বাড়ছেই। অথচ লুঙ্গি তোয়ালে গামছার দাম বাড়ছে না। আমরা মলাম-মহাজন, তিন বান্ডিল সুতো দেন’।
নিজে নিজেই বকবক করে সাড়ে ছয় হাজার টাকা টেবিলের উপর রাখে সলেমান। মহাজন এই টাকা দেখে রেগে আগুন। সাতাশ হাজার টাকা বাঁকি, মাত্র সাড়ে ছয় হাজার জমা দিচ্ছে সলেমান। এটা মেনে নিতে পারছে না সুতার মহাজন।
সলেমানের সাথে মহাজনের প্রচন্ড বাকযুদ্ধ শুরু হয়। সলেমানের জীবন বাঁচানোর লড়াই আর মহাজনের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। গরম ছোটাচ্ছে দ‘ুজনেই। বস্ত্র তৈরির কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি আর বস্ত্রের দাম কমতে থাকা বাজারে কঠিন বাস্তবতা উভয়কে অশান্তিতে ফেলেছে। পাশের দোকানীরা এসে মালিক-খরিদ্দারকে শান্ত করে।
হঠাৎ সলেমানের উল্টো কোমরে রাখা পুরাতন রং চটা বাটন ফোনটা বেজে উঠে। রিসিভ করতেই স্ত্রী সুফিয়া বেগম বলে উঠে-‘কালকে পহেলা রমজান। ঘরে তরিতরকারি কিছুই নাই। একটু মাছ কিনো—
রাগে ক্ষোভে সলেমান কটকট করতে থাকে। এযেন মরার উপর ফাঁড়ার ঘা। সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা আর ভাললাগেনা! আগে বাড়ী ফিরে আসি! মাছ খাওয়ার সাধ মেটাবো! লসে লুঙ্গি বিক্রি করলাম, মহাজনের টাকা দিতে পরিনি, সুতো দিচ্ছেনা। আবার মাছ, তরকারি! মরার উপায় খোঁজায় ভালো–
স্ত্রী কথা বলেই যাচ্ছে ওপাশ থেকে। আর শোনো-চাল আর কেনা লাগবিনা। এক বস্তা চাল, খেজুর, মিছরি, তেল, লবন, সাবান, পিয়াজ, আলু আর ডাল দিয়ে গেছে ওরা। ছোট মেয়ে ফুলির জন্য একটি ঈদের ফ্রগও দিয়েছে লাল কালারের।
‘কেডা দিয়েছে’? ভ্রু কুচকে কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চায় সলেমান। সুফিয়া বেগম জানায়, স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন ইয়থ ডেভলপমেন্ট ফোরামের (ওয়াইডিএফ) পক্ষ থেকে দিয়ে গেল এগুলো। রমজান ফুড প্যাকেজ। অনেককেই ওরা এভাবে নিয়মিত দেয়। আল্লাহ ওদের মঙ্গল করুক।
এক মাস চাল কেনার চিন্তা নেই। আনন্দ আর খুশী এখন সলেমানের শরীর জুড়ে। সুতো কেনা লাগবেনা, মহাজনের ঘর থেকে বের হয় সলেমান। মহুরি সরিদ বাবু পিছন থেকে ডাক দেয়- ‘এই সলেমান শোন শোন, দাঁড়া-দাঁড়া-শোন বলছি—
মহাজন সাব্বির হোসেন সলেমানের দেয়া টাকাগুলো ক্যাশে রাখতে রাখতে বলেন-‘যা যা, আর বাঁকীতে সুতা বেচবোনা, বেচবোনা তোর কাছে! ঘরের সুতা ঘরেই থাক, তাতেই শান্তি! জোলাদের নেবো-খাবো-দেবোনা স্বভাব কোনদিন যাবে না‘।
মহাজন আর সরিদ বাবুর কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ করে না দরিদ্র তাঁতী সলেমান। ভেতরে রাগে ফোস ফোস করছে সে। পায়ের পুরাতন সেন্ডেলের ফিতা ছিড়ে গেল। এতে রাগ যেন উঠে গেল মাথায়। রাগ আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ফিতা ছেড়া সেন্ডেলটি পা দিয়েই ছুড়ে মারে। অন্য সেন্ডেলটাও পায়ের জোরে ছুড়তে চায়, কিন্ত আটকে থাকে পায়ের সাথে। হাত দিয়ে খুলে কটমট করতে করতে ফটফট ছিড়ে ফেলে ফিতা। এবারও ছুড়ে ফেলতে যায়, তার আগেই এক শরবত বিক্রেতা এসে সামনে দাঁড়ায়। পা দিয়ে ছুড়ে ফেলা সেন্ডেলটা শরবতের বালতিতে পড়েছে। তাই পথ আটকে দিয়েছে। ‘আমার ৫০ গøাস শরবত নষ্ট হয়েছে, টাকা দিয়ে তার পর যা! রাগ খাটানোর জায়গা পাসনে!
শরবত বিক্রেতার কথায় হতভম্ব সলেমান। কী করতে কী হয়ে গেল! বিপদ আসন্ন। অগত্যা প্রতিবাদ করতে চেষ্টা চালায় সে। শুরু হয় প্রচন্ড বাকবিতন্ডা। জড়ো হতে থাকে পথচারী। বাধে জটলা। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তির শেষ নেই।
এমন সময় বিশাল এক প্রতিবাদ মিছিল প্রধান সড়ক দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে ওরা। তৌহিদী জনতার ব্যানারে গাঁজায় ইজরাইলের হামলার প্রতিবাদে এই মিছিল। সব বয়সী মানুষের তীব্র শ্লোগানে কেঁপে উঠে চারদিক। ব্যানারের সামনে ৪/৫জন যুবক মিছিলের পথ ক্লিয়ার করছে। সলেমান ও শরবত ওয়ালার জটলা এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয় ওরা। সলেমানকে ছেড়ে দিয়ে শরবত ওয়ালা নিজের দোকান ঠেকাতে ছুটে যায়। সলেমানও সুযোগ বুঝে মিশে যায় মিছিলে জনতার সাথে। গগণ বিদারী আউয়াজ তোলে-ইহুদীর বাচ্চারা-হুশিয়ার সাবধান, মরলে শহীদ-বাঁচলে গাজী, আমরা সবাই মরতে রাজি, দুনিয়ার মুসলিম-এক হও এক হও —
মহাজন, সেন্ডেল আর শরবত ওয়ালার উপর যত রাগ-ক্ষোভ ছিল সব যেন এখন আছড়ে পড়ছে নেতানিয়াহুর উপর। মিছিল চলছে, শ্লোগানে মুখরিত সারা শহর। মিছিলটি শহরের বক চত্বর ঘুরে আবার বাসষ্টান্ডের দিকে ফিরে যায়। সলেমানও আওয়াজ তোলে জোর গলায়। নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার—
মিছিলটি রেল স্টেশন চত্বওে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। সবাই ফিরে চলে নিজ নিজ গন্তব্যে। প্রান্তিক তাঁতী সলেমান হনহন করে হেঁটে যেয়ে সোজা হাজির হয় মাছ বাজারে। মেয়ে ফুলি কতবার বলেছে ইলিশ মাছ কিনতে। টাকার অভাবে কেনা হয়নি, আজ পকেটে থাকা ৪শত টাকায় জাটকা ইলিশের হাফ কেজি আর কিছু তরিতরকারী কিনে বাড়ীর দিকে যাত্রা করে সলেমান। মেয়েটি আজ খুব খুশি হবে। খু-উ-ব!
এসপ্তাহের তাসনের সুতা না নিয়ে মাছ হাতে বাড়ি ফিরছে সলেমান। এটা তার জীবনে প্রথম ঘটছে। কাঁধে সুতার পোটলা নেই। কিন্ত ভিন্ন অনুভূতিতে অবগাহন করছে সলেমান। তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হবে। মেয়ে ফুলিকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দেবে ইলিশের প্যাকেট।

সহকারী শিক্ষক, জোতমোড়া বালিকা বিদ্যালয়, কুমারখালী, কুষ্টিয়া। ০১৭১৭ ৫১২৬০০/

আরও খবর

Sponsered content