সারা দেশ

আবারও সংস্কৃতিকর্মী গ্রেপ্তারের নেপথ্যে কী

ময়মনসিংহে নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার কবি ও সংস্কৃতিকর্মী শামীম আশরাফকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল সোমবার কারাগারে পাঠানো হয়। আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের বিরোধকে কেন্দ্র করে তাঁকে হেনস্তা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ সংস্কৃতিকর্মীদের। এ নিয়ে নগরীতে ক্ষমতাসীন দলের বিবাদ ফের প্রকাশ্যে এসেছে এবং দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। ব্রহ্মপুত্র নদে হাঁটুপানিতে নেমে এর খননকাজে অনিয়ম এবং ময়মনসিংহ নগরবাসীর নানা ভোগান্তি নিয়ে প্রতিবাদ করে বেশ আলোচিত হন শামীম আশরাফ।

সমাজের অসংগতি তুলে ধরেন তিনি। সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে নাগরিক সমস্যা নিয়ে তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে করা হয় কিছু ডিজাইন, যা সদ্য সাবেক মেয়র মো. ইকরামুল হকের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। অভিযোগ উঠেছে, সে কারণে টিটুর বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হক শামীমের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা রোববার শামীম আশরাফের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হানা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ ডেকে তাঁকে তুলে দেওয়া হয়।নগরীর মদন বাবু রোডের আমপট্টি মোড়ে গ্রাফিটি নামে একটি গ্রাফিক ডিজাইনের দোকান ও ছাপাখানা আছে শামীম আশরাফের। তিনি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ডিজাইনার। কবি ও সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত মুখ শামীমের বাড়ি সদর উপজেলার দাপুনিয়া হারগুজিরপাড় গ্রামে।

রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আল আমিনসহ কয়েকজন নেতা শামীম আশরাফের দোকানে গিয়ে সাবেক মেয়র ইকরামুল হকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারমূলক পোস্টার তৈরি না করার অনুরোধ জানান। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে যান জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও মেয়রের বড় ভাই আমিনুল হক শামীম। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ শামীম আশরাফকে ধরে নিয়ে যায় থানায়। নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে হ্যান্ডকাফ পরা ছবি রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ময়মনসিংহ শহরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। এক গ্রুপে সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ইকরামুল হক টিটু ও অন্য গ্রুপে এমপি মোহিত উর রহমান শান্ত নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া শান্তর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন আমিনুল হক শামীম। জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দুই পক্ষের দূরত্ব বেড়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে সংসদ সদস্য শান্ত সাবেক মেয়র টিটুর জয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে নানা কাজ করছেন বলে অভিযোগ টিটুপন্থিদের।

শামীম আশরাফ সংসদ সদস্যের হয়ে কাজ করেন বলে অনেকের ধারণা।শামীম আশরাফকে গ্রেপ্তারের পর টিটু ও শান্ত গ্রুপের নেতাকর্মীর মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। রাতেই পৃথক স্থানে শত শত নেতাকর্মী অবস্থান নেয়। এদিকে শামীমকে গ্রেপ্তার করায় সংস্কৃতিকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আল আমিন বলেন, সভা-সেমিনারে যে কারও বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ থাকলেও রাতের অন্ধকারে কে বা কারা পোস্টার সাঁটাচ্ছিল– দীর্ঘদিন ধরে এর রহস্য উদ্ঘাটন করা যাচ্ছিল না। শামীম আশরাফের দোকানে গিয়ে তাঁর কম্পিউটারে এসব ডিজাইন পাওয়া যায়।

তাঁকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী বলেন, সিটি করপোরেশন সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর লোগো ব্যবহার করে কেউ অপপ্রচার করলে আইনের দৃষ্টিতে অবশ্যই তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। লোগো ব্যবহার করে সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তাই শামীম আশরাফের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এদিকে এমপি শান্ত নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তিনি লেখেন, ‘শামীম আশরাফ কবি, সাহিত্যমনা মানুষ।

শহর ঘুরে ঘুরে সমাজের অসংগতি তুলে ধরেন। মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেন। বিনোদনহীন শহরে নিজের অর্থে অনেক সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করেছেন মানুষের চিত্তবিনোদনের জন্য। ভুল করেছেন, না শুদ্ধ করেছেন, বিচার করবেন আদালত। তাঁর গায়ে এভাবে হাত দেওয়া নিশ্চয় আইনবিরুদ্ধ কাজ। তীব্র নিন্দা জানাই।’ সমকালকে শান্ত বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ কিছু বলতে পারে। কারও নাম নেননি শামীম। কিন্তু মুক্তচিন্তার টুঁটি চেপে ধরতে শামীমের সঙ্গে এমনটি করা হয়েছে।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত থানায় কয়েক দফা চেষ্টা করেও শামীম আশরাফের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মেলেনি। শামীমের ভক্ত কিংবা গণমাধ্যমকর্মী কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। তবে স্বল্প সময়ের জন্য দেখা করার সুযোগ পান স্ত্রী সাদিয়া তামান্না ও ৩ বছরের সন্তান তালহা আশরাফ মান্নাতা। সাদিয়া তামান্না বলেন, ‘স্বাধীন দেশে মতপ্রকাশের অধিকার সবার রয়েছে। নির্দোষ স্বামীর মুক্তি দাবি করছি।ময়মনসিংহ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নেওয়া হলে সেখানে শামীম আশরাফ বলেন, ‘আমার সন্তানেরা আকাশ দেখতে পারে না, আমি সেই কথা বলি। আমার ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যায়, আমি সেই কথা বলি। এটাই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং এই অপরাধ নিয়েই বাঁচতে চাই।’

গতকাল বিকেলে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। জেলা শাখার সভাপতি ও মেয়র প্রার্থী এহতেশামুল আলম ছাড়াও দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আরেক মেয়র প্রার্থী ফারামার্জ আল নূর তারেকও সেখানে ছিলেন।লিখিত বক্তব্যে এহতেশামুল আলম বলেন, আমিনুল হক শামীম বেশ কিছু নেতাকর্মী নিয়ে গ্রাফিটি প্রিন্টিং প্রেসে উপস্থিত হয়ে শামীম আশরাফের ওপর চড়াও হন। তারা প্রেসের কম্পিউটারে নগরীর নানা সমস্যা নিয়ে কিছু পোস্টারের ডিজাইন পান। পুরো ঘটনাটি ৪-৫ জন ফেসবুকে লাইভ করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, আমিনুল হক শামীমের কানে কানে শামীম আশরাফ কোনো কথা বলেননি।

কিন্তু একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আমিনুল হক শামীম বলা শুরু করলেন, ‘একটু আগেই তুমি না আমার কানে কানে বললা– আলম ভাই করাইছে।’ ওই মুহূর্তেই শামীম আশরাফ সবার সামনে আমিনুল হক শামীমের এই মিথ্যা দাবিটি অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আলম ভাই এখানে কাজ করান না, উনি ফিউশনে কাজ করান।’ এহতেশামুল আলম আরও বলেন, ‘নির্বাচনে একজন প্রার্থীর বড় ভাই কেন জনসমক্ষে আমাকে হেয় করার জন্য অপপ্রচারের চেষ্টা করেছেন, তা বোধগম্য নয়। হয়তো জাতীয় নির্বাচনে আমি তাঁর পক্ষে কাজ না করে নৌকা মার্কা নিয়ে কাজ করায় তিনি (আমিনুল হক শামীম) ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে এই অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছেন।

শামীম আশরাফ গ্রেপ্তার হওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা ও মুক্তির দাবি তুলেছেন সংস্কৃতিমনা মানুষ। কবি ও অনুবাদক সাঈদ ইসলাম বলেন, এ শহরের সবচেয়ে পরিচিত মুখদের একজন শামীম আশরাফ। কী কারণে তাঁকে আটক করা হলো, তা সবার কাছেই রহস্য। ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ বলেন, ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়েছেন শামীম আশরাফ। আমরা তাঁর মুক্তি চাই। লেখক ফরিদ আহমদ দুলাল সমকালকে বলেন, যা অন্যায় ও ভুল, তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করলে আক্রমণ করতে হবে– এটি শোভন নয়।

শামীম লিখেছেন, শহরে চলাচল করা যায় না; যানজট, নোংরা আবর্জনা– এসব তো সত্য লিখেছেন।শামীম আশরাফকে গতকাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। আদালত জামিন আবেদনের শুনানি না করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আজ মঙ্গলবার জামিন শুনানি হতে পারে।কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মাইন উদ্দিন বলেন, শামীম ধর্তব্য বা আমলযোগ্য অপরাধ করার মানসে জড়িত থাকতে পারেন– এমন সন্দেহ রয়েছে তাদের। তদন্ত শেষে বলা যাবে, তিনি জড়িত আছেন কিনা।শামীম আশরাফের পক্ষের আইনজীবী আল হোসাইন তাজ বলেন, যে অপরাধ দেখিয়েছে পুলিশ, তা আইনে নেই। শামীমের অপরাধ ৫৪ ধারায় পড়ে না।

%d bloggers like this: