মাহমুদ শরীফ :
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। এদিনে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তথা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। তখন বর্ষাকালের আকাশে ছিল মেঘ, তেমনি বাংলার ভাগ্যাকাশেও ছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। আকাশে মেঘের আড়ালে সূর্য হারিয়ে যাওয়ার মত বাংলার স্বাধীনতার সূর্যও ডুবে গিয়েছিল ২শ বছরের জন্য। প্রতিবছর পলাশী দিবস আমাদের নতুন করে শিক্ষা দেয় যুগে যুগে বিশ^াস ঘাতকদের কী পরিণতি হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা বজ্র কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত, ঠিক তখনই প্রধান সেনাপতি মীর জাফর গোপনে হাত মেলান ইংরেজদের সাথে। ইতিহাসের পাতায় সর্বকালের সবচেয়ে কুখ্যাত ও জঘন্য বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তাই মীর জাফরের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। এসব কুচক্রী এই কুশীলবদের জীবনের শেষ পরিণতির কথা বলছি–
ঘৃণার পাত্র মীর জাফর
ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী হয়ে আছে পলাশীর যুদ্ধ। পলাশীর যুদ্ধের পর প্রচুর ঘুষের বিনিময়ে রবার্ট ক্লাইভের হাত ধরে মসনদে আরোহণ করেন নবাব মীর জাফর আলী খান। তবে তাকে পুতুল বানিয়ে মূল ক্ষমতা পরিচালনা করেন ইংরেজরা। একপর্যায়ে বনিবনা না হওয়ায় মীর জাফরকে সরিয়ে তারই জামাতা মীর কাশেমকে ক্ষমতায় বসানো হয়। মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দ শুরু হলে ইংরেজরা মীর কাশেমকে সরিয়ে দেন। এ সময় বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর নির্লজ্জের মতো আবারও ইংরেজদের আজ্ঞাবহ নবাব হিসেবে বসেন। এতেও মীর জাফরকে ইংরেজদের অবজ্ঞা আর দেশীয়দের ঘৃণার পাত্র হিসেবেই জীবন কাটাতে হয়। ১৭ জানুয়ারি ১৭৬৫ সালে ৭৪ বছর বয়সে মীর জাফরের জাগতিক মৃত্যু ঘটলেও আসলেই কি মরেছেন মীর জাফর? এর উত্তর জানা যায় মুর্শিদাবাদের মীর জাফরের ধ্বংসপ্রায় প্রাসাদের সামনে গেলে। মীর জাফরের প্রাসাদে ঢোকার প্রধান ফটকটি ইতিহাসে, সরকারি দলিলে এবং ট্যুরিস্ট গাইড বইয়ে ‘নেমক হারাম দেউর’ বা ‘বিশ্বাসঘাতকের গেট’ নামে পরিচিত পেয়েছে। এখনও কোনো বেইমান বা বিশ্বাসঘাতককে গালি দিতে ব্যবহৃত হয় ‘মীর জাফর’ শব্দটি। তাই বলা হয়- মরেও বেঁচে আছে মীর জাফর। তবে শ্রদ্ধায় নয় মানুষের মুখে মুখে একটি জঘন্য গালি হিসেবে।
সলিল সমাধীতে ঘষেটি বেগম
মেহেরুন্নেসা বেগম নাম হলেও ইতিহাসে কুচক্রী নারীর প্রতীক হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে ঘষেটি বেগম। নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা নবাব আলীবর্দী খাঁর তিন কন্যা। তাদের নাম ছিল মেহেরুন্নেসা ওরফে ঘষেটি বেগম, মায়মুনা বেগম এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার মা আমেনা বেগম। স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসন্তান ঘষেটি বেগম স্বামীর অগাধ সম্পদের মালিক হন। নবাব তথা প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তারের লোভে ঘষেটি বেগম চেয়েছিলেন সিরাজ নয়, মেজ বোন মায়মুনা বেগমের পুত্র শওকত জং হোক বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব। কারণ শওকত প্রায় সারা দিনই মদপান করতেন। আর চাটুকারদের কথামতো সিদ্ধান্ত নিতেন। তাই তার ওপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হতো ঘষেটি বেগমের জন্য। তবে আলীবর্দী খানের ইচ্ছায় তার মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা মসনদে আরোহণ করলেও ঘষেটি বেগম তা মেনে নিতে পারেননি। ফলে সিরাজউদ্দৌলাকে মসনদ থেকে যে কোনো মূল্যে বিতাড়িত করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন ঘষেটি বেগম। এদিকে শওকত জং ক্রমান্বয়ে নবাবের অবাধ্য হতে থাকেন। দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় আরওরঙ্গজেবের প্ররোচনায় শওকত জং একপর্যায়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। দুই কোটি রুপির বিনিময়ে তিনি সম্রাট দ্বিতীয় আওরঙ্গজেবের কাজ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হওয়ার ফরমানও আদায় করে নেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বিশ্বস্ত ও সাহসী সেনানায়ক মহন লালের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠান পুর্নিয়া রাজ্যের রাজা শওকত জংকে শায়েস্তা করার জন্য। পলাশীর যুদ্ধের আট মাস আগে ১৬ অক্টোবর ১৭৫৬ সালে মহন লালের সৈন্যদের আক্রমণের মুখে শওকত জং মাতাল অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনা ঘষেটি বেগম প্রতিহিংসার আগুন আরও বাঢ়ে। এমনি প্রেক্ষাপটে লর্ড ক্লাইভ আর মীর জাফরের সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধে গোপন চক্রান্তে হাত মেলান ঘষেটি বেগম। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মীর জাফর ইংরেজদের হাতের পুতুল হয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। এতে ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তারের যে স্বপ্ন ঘষেটি বেগম দেখেছিলেন, তা অপূর্ণ থেকে যায়। একপর্যায়ে ঘষেটি বেগম দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েন মীর জাফর এবং তার পুত্র মীর মিরনের সঙ্গে। পরিণতিতে ঘষেটি বেগমকে বন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার (বর্তমান পুরান ঢাকায়) জিঞ্জিরা প্রাসাদে। এখানে বন্দী থেকেও ঘষেটি বেগম নতুন চাল শুরু করেন মীর জাফর এবং মিরনের বিরুদ্ধে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এবং ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে ভেবে মিরন ঘষেটি বেগমকে বন্দী অবস্থায় নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠানোর আদেশ দেন। নৌকা ঘষেটি বেগমকে নিয়ে জিঞ্জিরা প্রাসাদ ছেড়ে গেলেও মুর্শিদাবাদে পৌঁছেনি কোনো দিন। পথেই নৌকাডুবিতে ঘষেটি বেগমের সলিল সমাধি ঘটে বলে ধারণা করা হয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মাটিও ঠাঁই দেয়নি কুচক্রি ঘষেটি বেগমকে।
মৃত্যুদন্ডে মহারাজ কৃষ্ণচ›্দ্র রায়
পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলায় সাতজন হিন্দু রাজা ছিলেন। এদের মধ্যে বিচক্ষণ নদীয়ার শাসক মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় উপলব্ধি করেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় মুসলমানদের শাসনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। বিষয়টি তিনি অন্য ছয়জন হিন্দু রাজাকেও বুঝান। তিনি বুঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের সনাতন ধর্ম মুসলমানদের হাতে নিরাপদ নয়, ব্রিটিশদের হাতে নিরাপদ। ফলে হিন্দু রাজার সমর্থন নিয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দৃ হাত মেলান রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে। ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, রবার্ট ক্লাইভ পলামীর যুদ্ধ ময়দানে যাওয়ার সময় কৃষ্ণচ›্দ্র রায়ের প্রাসাদে রাত যাপন করেন। যুদ্ধের পর ইংরেজদের সঙ্গে এই সখ্য চললেও নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দে জড়ান মহারাজা। এই দ্বন্দের রেশ ধরেই কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে মৃত্যুদন্ড দেন মীর কাশেম।
আত্মহত্যায় লর্ড ক্লাইভ
দেশে বিদেশিদের এক নতুন অধ্যায় রচিত হয় পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আর এই যাত্রা শুরু হয় লর্ড ক্লাইভের হাত ধরে। তার পুরো নাম রবার্ট ক্লাইভ। সামান্য কেরানি হিসেবে ১৭৪৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন এবং একই বছরে কোম্পানির ব্যবসার কাজে ভারতে আগমন করেন। ভারতে কিছুদিন চাকরির পর তিনি নিজ দেশে ফিরে যান এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। দ্বিতীয়বার তিনি সরকারের পক্ষে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে ভারতে আসেন ১৭৫৬ সালে। এই যাত্রায় ভারতে এসেই তিনি ভারতবর্ষ তথা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারে কূটকৌশল চালাতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় পলাশীর যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে মীর জাফর এবং তার মিত্ররা। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু এবং মীর জাফরের ক্ষমতাগ্রহণের ঘটনা ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। আর উত্থান ঘটে লর্ড ক্লাইভের।
পলাশীর যুদ্ধের ১০ বছর পর ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ ইংল্যান্ড ফিরে যান। কিন্তু ভারতে রেখে যান ঘুন, দুর্নীতি, সম্পদ আত্মসাৎ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র আর অপরাজনীতির এক জঘন্য ইতিহাস। তার দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে ১৭৭২ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট তার দুর্নীতির তদন্ত করতে বাধ্য হয়। এতে একে তার দুর্নীতির তথ্য বেরুতে থাকে। আত্মসম্মানের কথা বিবেচনা করে তিনি সব সম্পদের বিনিময়ে তদন্ত বন্ধ তথা তার সম্মান রক্ষার অনুরোধ জানান। তবুও চলতে থাকে তদন্ত। এতে অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আত্মহত্যার জন্য তিনি নিজের শরীরে ছুরি চালান বা নিজেই নিজের গলায় ছুরি ঢুকিয়ে দেন বলে প্রচলিত আছে। তবে মরেও বেঁচে আছে লর্ড ক্লাইভ এক ঘৃণিতের আদলে।
দারিদ্র্যের কশাঘাতে মীর কাশেম
পলাশীর যুদ্ধে মীর কাশেম ছিলেন বিশ্বাসঘাতকদের কাতারে। সম্পর্কের দিক থেকে মীর কাশেম ছিলেন পলাশীর যুদ্ধের মূল বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের কন্যা নবাব ফাতিমা বেগম সীবার স্বামী। তাই পলাশীর যুদ্ধে শ্বশুর এবং শ্যালক মীর মিরনের মতো মীর কাশেমও মেতে ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের খেলায়। তবে তিনি সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দেন পলাশীর যুদ্ধের একদিন পর অর্থাৎ ২৪ জুন ১৭৫৭ সালে। পলাশীল যুদ্ধে পরাজিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম, কন্যা জহুরা এবং একজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে নৌকাযোগে পালিয়ে যান। পথে মীর জাফরের পুত্র মীর মিরনের নির্দেশে বিপথগামী সৈন্যরা নবাব এবং তার পরিবারকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসে। লুৎফুন্নেসা ছিলেন রূপে-গুণে অনন্যা। আটক হওয়ার পর মীর মিরন নবাবকে হত্যার উদ্দেশ্যে আলাদা করে নিয়ে যান। আর মীর কাশেম আটক করেন লুৎফুন্নেসাকে। মীর কাশেম ক্রমাগত অত্যাচার করে। লুৎফুন্নেসার কাছে নবাব পরিবারের সব সম্পদ বিশেষত গুপ্তধনের সন্ধান জানতে চান। পরবর্তীতে লুৎফুন্নেসাকে তার কন্যাসহ বর্তমান পুরান ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে দীর্ঘদিন আটক করে রাখেন। শেষ জীবনে লুৎফুন্নেসা ১৭৯০ সালে মোটামুটি সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু ইংরেজদের সমর্থন নিয়ে নবাবের সিংহাসনে আরহণ করলেও সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু ঘটেনি মীর কাশেমের। বনিবনা না হওয়ায় জামাতা মীর কাশেমের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সেনার দেশি অন্য শাসকদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ লিপ্ত হন।
১৭৬৪ সালের ২৩ অক্টোবর বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হন মীর কাশেম। তার একসময়ের মিত্র সূজা-উদ-দৌলাও তাকে নিজ এলাকা থেকে বহিষ্কার করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিল একটি ঘোড়া, হাতি আর কিছু ধন-রতœ। এরই মাঝে ডাকাত দল এসে ঘোড়া-হাতির পিঠে থাকা সবকিছু লুট কওে নিয়ে যায়। সবকিছু হারিয়ে শেষ বয়সে নিঃস্ব মীর কাশেস এক দুর্বিষহ জীবনে পতিত হন। কিছুদিন পালিয়ে বেড়ান মীর কাশেম। সবশেষে তিনি দিল্লির কোতোয়াল এলাকায় নিতান্ত দারিদ্র্য জীবনযাপন করতে থাকেন। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মীর কাশেমের মৃত্যু হয় ৮মে ১৭৭৭ সালে। মৃত্যুর পর বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার এককালের নবাব মীর কাশেমের ঘওে দেহ সৎকার করার মতো সম্পদও ছিল না। ঘরে থাকা মাত্র দুটি চাদর বিক্রি করে মীর কাশেমের দাফনের ব্যবস্থা হয।
বজ্রপাতে মৃত্যু মীর মিরন
বিশ্বাসঘাতকতাকারী সেনাপতি মীর জাফরের সন্তান মীর মিরন। ক্লাইভের প্রতিনিধি ওয়াটসনের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে মীর জাফরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন মীর মিরন। এমন কি মীর জাফরের প্রাসাদে ওয়াটসনের সামনে মীর জাফর মাথায় পবিত্র কোরআন নিয়ে যখন ব্রিটিশদের পক্ষে কাজ করার প্রতিজ্ঞা করেন তখন মীর জাফরের আরেক হাত ছিল তারই পুত্র মীর মিরনের মাথায়। নিজ মাথায় পবিত্র কোরআন আর নিজ পুত্র মিরনের মাথায় হাত রেখে জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার পরিণতি দেখতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি বাবা মীর জাফরকে। পলাশী যুদ্ধের তৃতীয় বর্ষ। ১৭৬০ সালের ৩ জুলাই। পুত্রের যে মাথায় হাত রেখে বাবা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন, সেই মাথায়ই অর্থাৎ মীর মিরনের মাথায় বজ্রপাত নেমে আসে। মিরনের বয়স তখন মাত্র ২১ বছর। এই যুবক পুত্রের লাশ বহনের ভাগপিতা মীর জাফরের হয়েছিল কিনা তাও অজানা।
পাগল হয়ে উমিচাঁদ
উমিচাঁদের আসল নাম আমির চাঁদ। তিনি ছিলেন একজন শিখ এবং জন্মসূত্রে পাঞ্জাবের বাসিন্দা। কিন্তু কলকাতায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছিলেন এবং ব্যাপক সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতেও তিনি অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন এবং মুর্শিদাবাদ কোর্টে কোম্পানির পক্ষে দালালি করতেন। এতে তিনি ব্যাপকভাবে লাভবান হন এবং কলকাতায় অনেক ঘরবাড়ি ও সম্পদ ক্রয় করেন। আরও লাভের আশায় তিনিও গোপনে লর্ড ক্লাইভ এবং মীর জাফরের সঙ্গে যোগ দেন। তবে তার লোভ এমনই পর্যায়ে পৌঁছে যে, একপর্যায়ে পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে পরাজিত করতে পারলে যে ধন-সম্পদ পাওয়া যাবে তার ৫ ভাগ দাবি করে বসেন উমিচাঁদ। অন্যথায় গোপন পরিকল্পনা ফাঁসের হুমকিও দেন। উমিচাঁদের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং এ লক্ষ্যে একটি চুক্তি করা হয়। চুক্তিটির দুটি কপি করা হয়। যার একটিতে উমিচাঁদকে অর্জিতব্য সম্পদের ৫ভাগ দেওয়ার কথা লেখা থাকলেও অন্যটিতে অর্থাৎ মূল কপিতে তা লেখা হয়নি। মূল কপিটি উমিচাঁদকে দেখানো হয়নি। প্রকৃত ঘটনা জানার পরে সে পাগল হয়ে যায়। শারীরিকভাবে দুর্বল হতে থাকে উমিচাঁদ। ক্রমেই হ্রাসপায় স্মৃতিশক্তি। এমনি এক অসহায় এবং করূণ অবস্থায় পাগল উমিচাঁদ ১০ বছর বেঁচে থেকে এ জগতেই তার লোভ এবং পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন। এমন ভয়াবহ পরিণতির পর ১৭৬৭ সালে উমিচাঁদের মৃত্যু ঘটে।
শিরচ্ছেদে জগৎ শেঠ
পলাশীর যুদ্ধে একদিকে যেমন ইংরেজদের কূটকৌশল এবং অস্ত্রশস্ত্র কাজ ছিল, অন্যদিকে ঠিক তেমিনভাবে ছিল জগৎ শেঠের টাকা। তার প্রকৃত নাম মহাতাপ চাঁদ। আর তার টাইটেল ছিল জগৎ শেঠ, যার অর্থ পৃথিবীর ব্যাংকার। মূলত এই টাইটেলটি প্রথম লাভ করেন তার দাদা ফাতেহ চাঁদ। মাড়োয়াদির সম্প্রদায়ের এই পরিবার মূলত সুদের কারবার তথা ব্যাংকিংয়ে জড়িত ছিল। পলাশীর যুদ্ধের আগেই বংশ পরস্পরায় পিতামহের টাইটেল জগৎ শেঠ তার নামের আগে সংযুক্ত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ইংরেজরা এদেশে আসতে থাকলে ইংল্যান্ডের মুদ্রার সঙ্গে ভারতীয় মুদ্রা বিনিময় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করে জগৎ শেঠ। তাই ইংরেজদের কাছে তার কদর ছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলকে পলাশীর যুদ্ধে হারানোর ষড়যন্ত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন জগৎ শেঠ। পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফরের আমলে ভালোই ছিলেন জগৎ শেঠ। কিন্তু পরবর্তীতে নবাব মীর কাশেমের সঙ্গে দ্বন্দে জড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে ইংরেজদের নিয়ে নতুন যড়যন্ত্র শুরু করেন জগৎ শেঠ। পলাশীর যুদ্ধের ছয় বছরের মাথায় ইংরেজদের কাছে লেখা যড়যন্ত্রমূলক একটি চিঠি লেখেন জগৎ শেঠ। কিন্তু চিঠিটি একপর্যায়ে নবাব মীর কাশেমের হস্তগত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নবাব মীর কাশেম এবং তাকে মুর্শিদাবাদ থেকে বিতাড়িত করেন। এদিকে ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যান নবাব মীর কাশেম এবং একপর্যায়ে হেরে যান। ক্রুদ্ধ নবাব মীর কাশেম এই পরাজয় মানতে পারেননি। তিনি ছুটে যান জগৎ শেঠের নতুন আস্তানা মাংঘরের উদ্দেশ্যে। মাংঘরের সামনে একটি টাওয়ারে আশ্রয় নিয়েও প্রাণ বাঁচাতে পারেননি জগৎ শেঠ। নবাব মীর কাশেম এবং তার সৈন্যরা জগৎ শেঠ মহাতাপ চাঁদ, তার কাজিন স্বরূপ চাঁদসহ তাদের পরিবারের সবার শিরচ্ছেদ করেন। অনেকের মতে, টাওয়ারের উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় এই দুই ভাইকে। আর এভাবেই জগৎ শেঠের জাগতিক লীলার অবসান ঘটে। যুগে যুগে বিশ^াস ঘাতকদের পরিনতি চরম পর্যায়ে খারাপ ছিল। সুতরাং এ থেকে শিক্ষা নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।