রাজনীতি

আবারও বিএনপির সংস্কার ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ন্যায্যতা

একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের আঘাতে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুই মেরুর একটি ভেঙে গেছে। যেহেতু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য দৃশ্যপটে ম্রিয়মাণ শক্তি, সেহেতু, যুক্তি বলে, সেখানে অবধারিত বিজয়ীর নাম হতে পারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরাচার সরকারের পতন পরবর্তী সাড়ে তিন দশকের মধ্যে তিন দশকই দেশ শাসন করেছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ।

এ সময়ের দুই–তৃতীয়াংশজুড়েই ছিল দেশের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রীর দোর্দণ্ড প্রতাপের শাসন; তবে তার গত সাড়ে ১০ বছরের শাসনামলে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে শেখ হাসিনা দল ও বল নিয়ে জনপ্রিয়তার বৈধ ম্যান্ডেটের ধারেকাছেও যাননি। এর আগে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ববর্তী সরকারি দল হেরে যায়। তাতে দেশে–বিদেশে এ ধারণা জন্মে যে আমেরিকা বা ব্রিটেনের ধাঁচে, একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে বাংলাদেশে।

তাই খালেদা জিয়া-শেখ হাসিনা বা বিএনপি-আওয়ামী লীগের ধারাবাহিক শাসনই মানুষের ভাবনায় প্রাধান্য পায়। কিন্তু ২০০৭ সালের ওয়ান–ইলেভেন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকার প্রথমে দুই নেত্রীকে বিতাড়িত করার (মাইনাস টু) ভান করলেও পরে শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতাসীন করা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচন দিয়ে এবং তিনিই ‘ছলা, কলা ও বল’ প্রয়োগ করে রাষ্ট্র শাসন করতে থাকেন সম্প্রতি পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।

শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচনে কারচুপি ও রাজনৈতিক অত্যাচার, বিশেষ করে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে কার্যত মাইনাস ওয়ানের চেষ্টা হয়। আবার আওয়ামী সরকারের স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিএনপিই দীর্ঘ প্রতিবাদ ও আন্দোলন জারি রাখে। ছাত্র, জনতা ও রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণে ফ্যাসিবাদ–বিরোধী আন্দোলন বিপ্লবে রূপ নেয়। যা হোক, বিএনপি-আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারণা এতটা প্রবল থাকে যে ২০২৩ সালে এক ভিডিও কনফারেন্সে এক শীর্ষ বিএনপি নেতা জিজ্ঞাসা করেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী এবং এর পরবর্তী নেতা কে?

যখন বলা হয়, গণ–আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতন হলে দলটির বিচারের দাবি উঠবে, তিনি বেশ অবাক হন। জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিটি সামনে এসেছে এ কারণে যে হাসিনা সরকার হত্যাকাণ্ড ও নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছে এবং পরাজিত হয়েছে, যদিও দল নিষিদ্ধের পক্ষে–বিপক্ষে নানা কথা আছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আকাশছোঁয়া দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ এমন সন্দেহও তৈরি করেছে যে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে সেই দলের নেতা–কর্মীরাও হয়তো অনুরূপ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে ডুবে যাবে!

এটি দেড় দশকে আওয়ামী লীগ-সৃষ্ট সন্দেহ এবং কিছুটা আওয়ামী আয়নায় বিএনপিকে দেখা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সচেতনভাবে আস্থা নষ্ট করার ফল। এখনই যদি গণরায়ের সম্ভাবনা বুঝে বিএনপিকে নানা কায়দায় আটকানোর (অপ) চেষ্টা হয়, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচারে কি খুব ন্যায়সংগত কাজ হবে? তাহলে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো বিএনপি তো বলতেই পারে, ‘আর কাউকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না।

এ ছাড়া শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ১৯৯১ ও ২০০১ সালে, ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো, হেরে হাওয়া নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সে জন্য এসেছে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দাবি। এ বিষয়ে বিএনপি সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতির সামনে ৩১ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করে ১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে।

বিএনপির প্রস্তাবে মোটাদাগে রয়েছে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সামাজিক চুক্তি, রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য, সংবিধান ও আইন সংস্কার, সংসদ সদস্য ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংহতকরণ, প্রশাসনিক সংস্কার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, গণমাধ্যমের স্বাধীন ভূমিকা, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, সন্ত্রাস ও বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, নারী কল্যাণ, ভারসাম্যপূর্ণ জাতীয় উন্নয়ন এবং স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি।

এখন বিএনপি উত্থাপন করেছে বলেই সেগুলোকে পাত্তা না দিলে ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপি যদি বলে, ঠিক আছে সংস্কারেরই দরকার নেই, তখন অগ্রিম সমালোচকেরা কী করতে পারবেন? বরং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না–করার খেলাটা তখন বিএনপির একচেটিয়া এখতিয়ার হয়ে দাঁড়াবে, যেমন আওয়ামী লীগ খেলেছে জামায়াত কার্ড।তবে বিএনপির সামনে সুযোগ এসেছে প্রমাণ করার যে দলটি নিছক আওয়ামী লীগের বিকল্প নয়, বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ ও নতুন প্রজন্মকে দূরদর্শী ধ্রুপদি গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব উপহার দেওয়ার।

বিপ্লবের অন্য অংশীজনেরা বিএনপিকে সে লক্ষ্যে নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ দিতেই পারেন; তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও নিন্দুকেরা দলের সংস্কারও চাইতে পারে। সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী নেতৃত্ব এবং এর সহযোগীদের হত্যা, বাড়াবাড়ি, দুর্নীতি ও জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনসহ তাদের কৃতকর্মের জন্য বিচার নিয়ে অপরাধী ছাড়া কারও পক্ষে আপত্তি করা অসম্ভব। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার আছে কি নেই, তা মীমাংসা করা একটি নৈতিক, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক শাসনতান্ত্রিক এবং ঐতিহাসিক প্রশ্ন এখন।

আপনি যখন তাকে ফ্যাসিস্ট বলছেন এবং বিপ্লব ও ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিচারে পরাজিত শত্রু বলে চিহ্নিত করেছেন, তখন এই প্রশ্ন সামনে আসবে। জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি দলকে রাজনীতি করতে দেওয়া হয় কি না, সেই প্রশ্ন তখন সামনে আসবে। আজ যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকত, এই লেখা দূরে থাক, আন্দোলনকারী ও সমর্থকদের কী অবস্থায় থাকতে হতো? অন্যান্য দল বা গোষ্ঠীগুলো কি সুষ্ঠু নির্বাচন ও সংস্কারের ইস্যুতে কাজ করার সুযোগ পেত?

১৯৫৬, ১৯৭২, ১৯৯৬ এবং ২০০৯ সালে মোট চারবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে মাত্র একবার, তা-ও ২০০১ সালে, যখন তারা আশা করেছিল তাদের সাজানো প্রশাসন নির্বাচনপ্রক্রিয়া প্রভাবিত করে তাদেরই ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনবে। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল কায়েম করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যার পাশাপাশি নিজেকেও নিষিদ্ধ করে ফেলে। ২০০১ সালে রাষ্ট্রীয় গণভবন নিজের নামে লিখে নেন শেখ হাসিনা।

২০০৯ সালে এসে নির্বাচনব্যবস্থাসহ গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে তার দল। সেরকম একটি দল কি ভবিষ্যতে পরিবর্তিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, আবার (প্রতিশোধ নেওয়ার) সুযোগ পেলে, গণতান্ত্রিক আচরণ করবে এবং অন্যদের তা করতে দেবে? প্রশ্নটি জনগণের ওপর ছেড়ে দিলে কেমন হয়? সে জন্য নির্মোহ যৌক্তিক আলোচনা ও বিশ্লেষণ দরকার সংশ্লিষ্ট সব ফোরামেই। আগামী সাধারণ নির্বাচনই হতে পারে সংবিধান, কল্যাণ রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ঠিক করার গণভোট।