খেলাধুলা

যে ফুটবল বিশ্বে পেলে-ম্যারাডোনা নেই

অনন্তলোকের ডাক এড়ানোর সাধ্য কার আছে। দরিদ্র পল্লীতে জন্মের পর জীবনযুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করে টিকেছিলেন এডসন অ্যারান্তেস দো নসিমন্তে; ফুটবলের রাজা পেলে নামেই যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বল পায়ে জাদুকরী ছোঁয়ায় দশকের পর দশক মাতিয়ে রেখেছেন কোটি ভক্তকে। মরণঘাতী ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শারীরিক শক্তি হারিয়েছেন। তবুও ফুটবল থেকে দূরে থাকতে পারেননি।

কাতার বিশ্বকাপের সময় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। কেমোথেরাপি কাজ করছিল না বলে ‘এন্ড-অফ-লাইফ’ ইউনিটে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল তাকে। সে অবস্থায় থেকেও ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রাণভরে উপভোগ করেছেন বিশ্বকাপ। নিজ দলের উত্তরসূরীদের সাফল্যে আনন্দিত হয়েছেন, আবার চূড়ান্ত পতনে ব্যথিতও হয়েছেন।

হয়তো আরও আগেই সময় পুরিয়ে এসেছিল কালো মানিকের। ডাক্তাররা আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু ফুটবলের রাজা হয়তো বিশ্বকাপের আনন্দটা ম্লান করতে চাননি বলেই লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারলেন আর কটা দিন। তবে বয়সটা আর সায় দিচ্ছিল না। পাড়ি দেন না ফেরার দেশে।এদিকে ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর ফুটবল জগতে আছড়ে পড়ে শোকের কালো ছায়া। এ দিনই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ফুবলের অবিসংবাধিত নায়ক দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা।

৬০ বছর বয়সে পৃথিবীর কাউকে কিছু না বলে ওপারে চলে গেলেও বিশ্ব ফুটবল প্রেমীদের হৃদয়জুড়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।গেল কয়েক দশকে মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথ সমর্থকদের দুইভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। তারও আগে বারবার আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে ম্যারাডোনা-পেলে জুটি। যদিও তারা ছিলেন দুই জন দুই যুগের আলোকবর্তিকা। তবুও যুগযুগান্তরে তাদের মধ্যে কে সেরা সেটি নিয়ে তর্ক হয়েছে। যে তর্কে শামিল হয়েছিলেন খোদ এই দুই কিংবদন্তিও।

দুজনের সম্পর্কটা ঠিক বৈরী বললেও আসলে কম বলা হয়। একটা সময় পেলে-ম্যারাডোনার মুখ দেখাদেখিই প্রায় বন্ধ ছিল। বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের নির্বাচনের কথা তো অনেকেরই মনে থাকার কথা। বিপুল ব্যবধানে পেলেকে হারিয়ে সেই খেতাব জিতে নেন ম্যারাডোনা। কিন্তু পেলের অনুরাগীরা দাবি করলেন, যেহেতু ভোট দিয়েছে সাধারণ মানুষ, তাই বহু আগে অবসর নেয়া পেলেকে গুরুত্ব না দিয়ে সদ্য অবসর নেয়া ম্যারাডোনার পক্ষেই তাদের ভোট যাবে এটা স্বাভাবিক।

পরে ফিফা ম্যাগাজিনের পাঠকদের ভোট নেয়া হয়। সেই সঙ্গে আবার বিচারকদের ভোটে জয়ী হন পেলে। দুজনকেই পরে একসঙ্গে সেরা ঘোষণা করা হয়। ইতিহাসের অমোঘ ইশারায় আসলে অমীমাংসিতই যেন রয়ে গেল এই তুলনা।দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশ এবং ক্লাবের হয়ে অজস্র ট্রফি জিতেছেন। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে ফুটবলারদের এক দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যাবে যারা কিনা ট্রফি সংখ্যায় পেলে বা ম্যারাডোনার চাইতে কোনো অংশে কম নন।

তাহলে কেন পেলে-ম্যারাডোনাই অবিনশ্বর হয়ে থেকে যান মানুষের হৃদয়ে, অন্যদের কমতিটা কোথায় ছিল।ম্যারাডোনাতে মানুষ পেয়েছিল আপন জীবনের চিত্রায়ন। ফুটবল মাঠে যেন কবিতা লিখতেন, সবুজ গালিতায় ছন্দ তুলে এগিয়ে যেতেন সবকিছু পেছনে ফেলে। আবার তিনি ফেরেশতাও নন, মূহুর্তের আবশ্যকতায় হাত দিয়ে গোল করে। হ্যান্ড অফ গডের নাম করে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেন।

মাঠের বাইরের জীবনটা তার আরো রঙিন। জীবনভর নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেছেন, আবেগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাই করেননি, আবার কখনো সখ্যতা গড়েছেন ইতালিয়ান মাফিয়ার সাথে।অন্যদিকে, পেলে ছিলেন ম্যারাডোনার সম্পূর্ণ আলাদা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জিতে আট বছর আগে বাবাকে দেয়া কথা রেখেছেন। পরবর্তীতে আরো দুটি বিশ্বকাপ জিতে নিজেকে নিয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার ব্যক্তিগত জীবনটাও কম রঙিন নয়, তবে কখনো লাগাম ছাড়া হতে দেননি। নিজের সম্মানের জায়গাটা কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেননি।

ফুটবল মাঠে যা কিছু জেতা সম্ভব সবই নিজের করে নিয়েছেন, ফুটবলের প্রথম বৈশ্বিক তারকা এমনকি যুদ্ধও থামিয়ে দিয়েছিলেন একবার। আর সবকিছুই তিনি করেছেন মুখে হাসি নিয়েই।ম্যারাডোনা আর পেলে দুজনেই ছিলেন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। অথচ তাঁদের গল্পটা কোনো অংশেই রূপকথার সেই গল্পের চাইতে কম রোমাঞ্চকর না। পৃথিবীর বড় একটা অংশের কাছে পেলে-ম্যারাডোনার গল্পটা জীবন্ত ছিল বহু সময় ধরে।

২৫ নভেম্বর, ২০২০-এদিনই প্রথমবারের মতো ধাক্কা খায় গোটা বিশ্ব। মাত্র ৬০ বছর বয়সে লুজনে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন দুই জাদুকরের একজন ম্যারাডোনা। গোটা বিশ্বজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। শোকাতুর পরিবেশে সান্ত্বনা দেবার জন্যে সেদিন একজন ছিলেন, পেলে।পেলে এবং ম্যারাডোনা দুজনেই মাঠের বাইরে অম্লমধুর এক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। দুজনেই একে অন্যের ফুটবলশৈলীর প্রশংসা করেছেন, আবার একই সাথে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েননি দিনশেষে তিনিই সেরা।

ম্যারাডোনার স্মরণে পেলে সেদিন লিখেছিলেন, ‘আমি কাছের একজন বন্ধুকে হারিয়েছি আর পৃথিবী হারিয়েছে একজন কিংবদন্তিকে। অনেক কিছুই বলার আছে, কিন্তু এই মূহুর্তে ঈশ্বর তার পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দান করুক। আশা রাখি একদিন হয়তো আমরা দুজনে আকাশে ফুটবল খেলবো। ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ -দুই বছরের কিছু সময় বাদে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন পেলে। পৃথিবীর সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করে যাত্রা করেন অনন্ত মহাকালে আগে থেকেই থাকা বন্ধুর উদ্দেশ্যে।

পেলে এবং ম্যারাডোনা দুজনেরই চলে যাবার পর পৃথিবী হারিয়েছে তার দুই আইকনকে আর মানুষ হারিয়েছে তার জীবনের নায়ককে। কিন্তু রূপকথার গল্পের মতোই পেলে-ম্যারাডোনা রয়ে যাবেন জীবন্ত হয়ে, তাদের কীর্তি রটে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে।তারা বেঁচে থাকবেন সমর্থকদের হৃদয়ে। বেঁচে থাকবেন ফুটবল পায়ে দৌড়ানো খুদে ফুটবলারের স্বপ্নে, বেঁচে থাকবেন ফুটবলপ্রেমীদের ভালোবাসায়।

%d bloggers like this: