Uncategorized

সুদহার বাড়লে আর্থিক খাতে নামবে ধস বললেন ডঃ সেলিম রায়হান

বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যখন সুদহার বাড়িয়েছে, আমাদের এখানে ঋণে ৯ শতাংশ এবং আমানতে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে সুদহার কমিয়ে রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন এক সময় সুদহার বাড়ানো হচ্ছে, যখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমেছে। আবার ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে এ সময়ে সুদহার অনেক বাড়লে আর্থিক খাতে ধস নামবে।

গতকাল শনিবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান এমন মত দেন। ঘোষিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, প্রবৃদ্ধি অর্জন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংস্থাটির উপস্থাপনা তুলে ধরেন সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা।

উপস্থাপনায় বলা হয়, বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সামাজিক নিরাপত্তায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। কালো টাকার সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি।ড. সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি থাকলেও তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এক বছর আগের তুলনায় উদ্বেগের মাত্রা বেড়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তি ঠিক করতে না পারলে এক বছর পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

তিনি বলেন, ‘২০১০ থেকে করোনার আগ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির জন্য ছিল সুবর্ণ সময়। প্রবৃদ্ধি ছিল উচ্চ, মূল্যস্ফীতি সহনীয় ছিল। ওই সময়েও ব্যাংক খাত এবং করব্যবস্থার সংস্কার না করায় আমরা লাইনচ্যুত হয়েছি। আমাদের ভিত নড়বড়ে হওয়ায় এখন সমস্যায় পড়েছি।’ তাঁর মতে, পরিস্থিতি উত্তরণে দুই বছরের জন্য একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে দুর্নীতির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাদের দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে এর বাইরে আরও যারা আছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় সংসদ থেকে একটি কমিটি করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে অনেক দেশের মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে কমছে না। এর অন্যতম কারণ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া। এখানে অনেক দেরিতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সুদহার বাড়ানো হয় মূলত চাহিদা নিয়ন্ত্রণের জন্য। তবে ধারাবাহিকভাবে ৯ থেকে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা এরই মধ্যে এমন জায়গায় নেমেছে যে, সুদহার বাড়িয়ে কাজ হবে না। আবার ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গত এক দশক ধরে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। ফলে সেখানেও সুদহারের কোনো প্রভাব পড়বে না।

বরং এ সময়ে সুদহার অনেক বাড়লে আর্থিক খাতে ধস নামবে। ডলারের দর বাড়ানো হলেও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে যত দেরি হবে, সমস্যা তত বাড়বে।সেলিম রায়হান বলেন, ব্যাংক খাত ও কর ব্যবস্থায় সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নেই। ব্যাংক খাত সংস্কারে এখন সুদহার বাড়ানো বা ব্যাংক একীভূত করার কথা বলা হচ্ছে। তবে এ খাতের গভীর সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে কর দিতে সক্ষম অনেকে করের বাইরে রয়েছেন।

ঋণখেলাপি, করখেলাপি ও কালো টাকার মালিকরা একই সূত্রে গাঁথা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইতস্তত করলে হবে না।সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে বিভিন্ন সময়ে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেন। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এবারের কঠিন সময়েও এ বিষয়ে যে ধরনের কঠিন পদক্ষেপ দরকার, তা বাজেটে নেই।তিনি মনে করেন, করের আওতা না বাড়িয়ে এবারও গতানুগতিকভাবে কেবল প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ওপর করের বোঝা আরও বাড়বে। এর পরিবর্তে ধনীদের ওপর কর বাড়ানো দরকার ছিল। কেননা তারা নানাভাবে কর দেন না।

তিনি বলেন, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব নিন্দনীয়। ন্যায়ভিত্তিক সমাজের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এর ফলে অনেকে কর ফাঁকি দিতে উৎসাহিত হবেন।ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিতে হবে।

এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ আরও বাড়বে।সায়েমা হক বিদিশা আরও বলেন, রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে ১৮ বিলিয়নে নামার প্রধান কারণ দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে দর ধরে রাখা। শুধু প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়বে না। হুন্ডি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে দরের পার্থক্য কমাতে হবে।

%d bloggers like this: