29 April 2024 , 6:47:04 প্রিন্ট সংস্করণ
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার বিচারের অপেক্ষায় স্বজনদের এক দশক কেটে গেল।১০ বছর আগে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (লিংক রোড) থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহরণের শিকার হন।
তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারাদেশের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন।এই মামলার রায়ে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে যান।
২০১৮ সালের অগাস্টে উচ্চ আদালত ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। সব আসামিই কারাগারে আছেন।আসামিদের পক্ষে আপিল করা হয় কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরেই শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মনিরুজ্জামান বুলবুল।
ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান বীর মুক্তিযোদ্ধা: সাত হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারানোদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ৮০ বছর বয়সি হায়দার আলীর ছেলে মনিরুজ্জামান স্বপন।বার্ধক্যজনিত কারণে সম্প্রতি তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।হায়দার আলীর আরেক ছেলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান খান বলেন, প্রতিবছর এপ্রিল মাস এলেই ছেলের শোকে কাতর হয়ে পড়েন আমার বয়স্ক বাবা-মা।
ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ২০ এপ্রিল বাবাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।তার কথা বলা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। তার কেবল একটাই ইচ্ছা, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তিনি কেবল ছেলের হত্যাকারীদের সাজা কার্যকর হয়েছে, এইটা কথাটা শুনতে চান।
সাতখুনের মামলাটি আপিল বিভাগ থেকে দ্রুত নিষ্পত্তি করে হত্যাকারীদের দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার দাবিও জানান নিহত স্বপনের ভাই মিজানুর রহমান।হত্যার শিকার সাতজনের একজন ছিলেন স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। ঘটনার সময় তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
জাহাঙ্গীর ১০ বছর বয়সি কন্যা রোজা বাবার আদর কী তা জানে না।বাবার মৃত্যুর একমাস পর জন্ম নেওয়া রোজার কাছে বাবা মানে কেবল তার পুরোনো ছবিগুলো।তা আকড়েই বাবা হারানোর বেদনা প্রশমনের চেষ্টা করেন ছোট্ট এই শিশু।প্রতিরাতে বাবার জন্য কান্না করি। তার একটা ছবি আমি সবসময় সাথে রাখি। যখন ছবিটা দেখি তখন মনে হয় বাবা আমার সাথেই আছেন, বাবার ফটোফ্রেমের উপর হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলার সময় চোখের পানি উল্টো হাতে মুছছিল শিশু রোজা।
ঘটনার দিন একটি মামলায় হাজিরা শেষে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাড়ি ফেরার জন্য রওয়ানা হয়েছিলেন। তবে তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।দীর্ঘ বছরেও এই মামলার আসামিরা শাস্তি না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বলেন, মামলাটি রায় হয়ে গেছে কিন্তু সাজা কার্যকর হচ্ছে না। অপরাধীরা অনেক প্রভাবশালী। সেই প্রভাবের অপব্যবহার করেই রায় কার্যকর হতে দিচ্ছে না তারা।
তবু বিচার বিভাগের ওপর ভরসা করে আছি। যতদিন না রায় কার্যকর হচ্ছে, তত দিন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকব।সাজাপ্রাপ্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় স্বজনরা এখনও আতঙ্কে থাকেন বলেও জানান সেলিনা।নজরুলের রেখে যাওয়া বাড়িটি ভাড়া দিয়ে কোনোমতে সংসার ও তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন বলে জানান সেলিনা।
তার বড় ছেলে তরিকুল ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় এমএসসি করছেন।ছোট ছেলে জাহিদুল ইসলাম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং একমাত্র মেয়ে নাজিফা ইসলাম একটি মেডিকেল কলেজে পড়ছেন।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নজরুলের স্ত্রী বেলন, তাদের বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে-মেয়েরা ভালো জায়গায় পড়াশোনা করবে, জীবনে সফলতা পাবে। তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে কিন্তু তা দেখার জন্য লোকটাই বেঁচে নেই। আফসোস!
হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্য তিনজন হলেন- নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, আইনজীবী চন্দনের তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম।মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে থাকলেও গত ৫ বছরে কোনো শুনানি হয়নি জানিয়ে বাদী পক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, নারায়ণগঞ্জে বিচারিক আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেছে ২০১৭ সালে।
এরপর কয়েকজনের সাজা কমালেও পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করে হাই কোর্ট। এরপর আসামিরা আপিল করলে, মামলাটি সেখানে ঝুলে আছে।মামলাটি অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত শুনানি বিষয়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আসামিরা ও রাষ্ট্রপক্ষ এমনটা চান না। তারা চাইলে দ্রুত শুনানি সম্ভব। এটি একটি ওয়েল প্রুভড কেস। আমরা আশা করি, দেরিতে হলেও এই রায়ই বহাল থাকবে, বলেন বাদী পক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান।