আন্তর্জাতিক

আরব-মুসলিম বিশ্ব যতদিন চুপ থাকবে যুদ্ধ চলবে

সরাইলের একের পর এক হামলায় ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে গাজা উপত্যকা। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ধ্বংসযজ্ঞ। বিশাল বিশাল ভবনগুলো মাটির সঙ্গে মিশে ধূসর ছাই হয়ে গেছে। বড় বড় কংক্রিটের নিচে পিষ্ট মানুষের রক্তে এখন রক্তাক্ত গাজার মাটি। ভারী ভারী ধ্বংসস্তূপ থেকে ভেসে আসে চিৎকার, বেঁচে থাকার আকুতি। হাসপাতালগুলোতে অসহায় মানুষের আর্তনাদ-আহাজারি। যে তরুণ ও শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তাদেরই ইসরাইলের প্রথম টার্গেট। লেখাপড়া শিখে যারা নিজেদের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ তুলত তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। শুক্রবার যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে চিত্রই তুলে ধরলেন গাজায় হামাস সরকারের গণসংযোগ ও শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আহমেদ আয়েশ আলনাজ্জার। হোয়াটসঅ্যাপ-ইমেইলে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হৃদিতা ইফরাত।

আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনি? গাজায় চলমান ইসরাইলের বর্বর আক্রমণ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। ইসরাইলের এ হামলা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। এমন ধ্বংসযজ্ঞ এবং নিষ্ঠুরতা আমরা এর আগেও দেখেছি। এখন পর্যন্ত বহু ফিলিস্তিনিকে আমরা হারিয়েছি। যুদ্ধকালীন ভয়াবহ পরিস্থিতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। চোখে না দেখলে এ কঠিন মুহূর্ত বোঝানো সম্ভব না।

অবরুদ্ধ গাজার এ যুদ্ধের শেষ কোথায়? কবে শেষ হবে বলে মনে করছেন?

যুদ্ধ ততদিন চলবে যতদিন আরব এবং মুসলিম বিশ্ব চুপ থাকবে। আমাদের শিশু, নারী এবং বয়স্কদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। আমাদের আরব এবং মুসলিম বিশ্ব থেকে জোরালোভাবে ইতিবাচক সাড়া দরকার। তারা যদি জাতিসংঘ এবং নিরাপত্তা পরিষদকে চাপ দেয় তবে আমাদের সঙ্গে ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুসলিম এবং আরব বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হলে পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

চলমান এ যুদ্ধে গাজায় এ পর্যন্ত কতজন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক এবং শিক্ষানবিশ নিহত হয়েছেন?

আসলে ইসরাইলের চলমান হামলায় কতজন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক বা শিক্ষানবিশ নিহত হয়েছেন তা সঠিক তথ্য দিতে পারছি না। তবে ধারণা করছি সব মিলিয়ে ১০০০ জন শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী নিহত হয়েছেন। আমরা যুদ্ধ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছি। নতুন বোমা হামলায়ও অনেকে নিহত হচ্ছে। ফলে এখনই আসল সংখ্যা জানা সম্ভব নয়।

যুদ্ধপীড়িত গাজায় শিক্ষার হার কেমন?

গাজায় শিক্ষিত মানুষের শতাংশ বেশ ভালো। আমাদের নিরক্ষর মানুষ নেই বললেই চলে। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে এবং গাজা উপত্যকার সব ফিলিস্তিনি পড়তে এবং লিখতে পারে। নিরক্ষর লোকের এক-শতাংশেরও কম। তবে এই শতাংশের মধ্যে ড্রপআউট ছাত্র রয়েছে। যারা স্কুলে পড়তে আসে ঠিকই কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে স্কুল ছেড়ে দেয়। কারণ তারা কাজ করতে চায়। দরিদ্র পরিবারের জন্য আয়ের কোনো উৎস খুঁজে বের করতে তারা আর পোড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কি ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় ফিরবে বলে মনে করছেন?

আমরা শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। আমরা মনে করি শিক্ষা আমাদের আত্মার অস্ত্র। এখানে সবাই শিক্ষার গুরুত্ব বোঝে। আমাদের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমাদের শিক্ষার প্রয়োজন। এটা একটা পেশার মতো। যেহেতু আগেই বললাম আমাদের নিরক্ষরতার হার খুব কম সুতরাং যুদ্ধ শেষ হলেই আমাদের বাচ্চারা শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ছুটে আসবে হোক সেটা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়।

গাজার শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হয়?

ফিলিস্তিনের শিক্ষাব্যবস্থা আরব এবং অন্য দেশগুলোর মতই। আমাদের প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে ৩ বছর, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ৬ বছর, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার জন্য আরও ৩ বছর ব্যয় করতে হয়। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ৬ বছর থেকেই বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে। অনেকে যারা কিন্ডারগার্টেনে যায় তারা ৪-৫ বছরেই স্কুলে যাওয়া শুরু করে।

গাজায় পড়াশোনার খরচ কি সরকার বহন করে? আপনাদের ছেলে এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কত?

জি। গাজায় পড়াশোনা ফ্রি (বিনা বেতনে)। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য খরচ বহন করতে হয় না। আমাদের ছেলে এবং মেয়ে মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০৯৭৫১ জন। শুধু সাধারণ শিক্ষায় ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।

আপনাদের বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কত? এদের মধ্যে বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে কি?

আমাদের সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৯১টি। বিদ্যালয়গুলো সরকার ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় পরিচালিত হয়। তবে আমাদের স্কুল ভবন সংখ্যার ঘাটতি রয়েছে। আমরা ডাবল শিফটে কাজ করতে বাধ্য হই। আমাদের সকালের শিফট এবং বিকালের শিফট আছে। সকালের শিফট সকাল ৭টা থেকে শুরু হয় এবং প্রায় ১১:৪৫-এ শেষ হয়। এরপরই বিকালের শিফট শুরু হয়। সরকারি খাতে ৩০৩টি স্কুল ভবনের মধ্যে ৪৪২টি স্কুল রয়েছে। এছাড়াও আমাদের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ রয়েছে। আমি ইনশাআল্লাহ আপনাকে উচ্চশিক্ষার জন্য বার্ষিক পরিসংখ্যান বই পাঠাব, যাতে আপনি গাজা স্ট্রিপের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের সংখ্যা পেতে পারেন। আমাদের একটি মাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর নাম আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের দুটি সরকারি কলেজও রয়েছে, বাকিগুলো সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গাজার ছাত্রছাত্রীরা কোন কোন দেশকে বেশি প্রাধান্য দেয়?

গাজার শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য মিসর, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করতে পারে। তবে এটি বৃত্তির ওপর নির্ভর করে। আমাদের মেডিসিন অনুষদ রয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই মাস্টার এবং পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে।

হামাসকে আইএসের সঙ্গে তুলনা করছে ইসরাই। একই সুরে কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্রও। আসলেই কি হামাস-আইএস এক? তাদের মধ্যে পার্থক্য কী?

আইএস হলো একদল দানব, যাদের ইসলামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। হামাস হলো স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের একটি দল। মধ্যপন্থি দলটি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে চায়। আইএস ইয়েমেন, মিসর এবং অন্যান্য অঞ্চলে হামাসের অনেক সদস্যকে হত্যা করছে। হামাস আইএসের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে। ফিলিস্তিনের বাইরে হামাসের কোনো কার্যক্রম নেই এবং তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসরাইলি দখলদারিত্ব থেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা। হামাস নারী বা শিশু এমনকি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার অনুমোদন দেয় না। হামাস শুধু ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে।

ধন্যবাদ আপনাকে। চরম এই সংকটকালে যুগান্তরকে সময় দেওয়ার আরও একবার ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আপনাকেও ধন্যবাদ। আল্লাহ ভরসা।

আরও খবর

Sponsered content