জাতীয়

এবার যুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার রেল নেটওয়ার্ক

লাল-সবুজের ছয়টি বগি ও একটি ইঞ্জিন এনে রাখা হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়া রেলওয়ে স্টেশনে। আগামী ১৫ অক্টোবর নবনির্মিত রেলপথ দিয়ে প্রথম পরীক্ষামূলক ট্রেন চালুর কথা রয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। তাদের প্রত্যাশা, চলতি বছরেই বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে।সারাদেশের সঙ্গে কক্সবাজারকে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতি সমৃদ্ধি হবে। সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত এই প্রকল্পের কাজ ৮৯ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ১১ শতাংশ কাজ শেষ হবে আগামী মাসের মধ্যে। এর পরই রেলপথে স্বপ্নদুয়ার খুলবে কক্সবাজারের। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানি করা নতুন বিলাসবহুল মিটারগেজ কোচ দিয়েই এই লাইনে যাত্রী পরিবহন করা হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন জটিলতা, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে দ্রুতগতিতে কাজ শেষ হওয়ার পথে। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম চৌধুরী জানান, কাজ শেষের দিকে। আমাদের এখন ফিনিশিং কাজ চলছে। শতাংশ হিসাবে এখন কাজের অগ্রগতি বলা কঠিন। তবে ৮৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এখন পর্যন্ত। আশা করছি, আমরা ১৫ অক্টোবর ট্রায়াল রান করাব। এটি পরিকল্পনায় রয়েছে। এ জন্য পটিয়া স্টেশনে বগি ও ইঞ্জিন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ট্রায়ালের আগের দিন সেগুলো দোহাজারী নিয়ে যাওয়া হবে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। চলতি বছরেই বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে আশা রাখি। ইতোমধ্যে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ২৫১টি ছোট-বড় ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক রেলওয়ে স্টেশন।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চলমান রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে, যার ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। মেয়াদ বৃদ্ধি করে তা আগামী বছরের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা চলতি বছরের অক্টোবরেই সম্পন্ন হচ্ছে।উদ্বোধনের পর প্রথমে একটি ট্রেন সার্ভিস চালু করার পরিকল্পনা প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করেছে রেলওয়ে। পূর্বাঞ্চলের পক্ষ থেকে ঢাকা-কক্সবাজার লাইনে ট্রেনের সময়সূচি তৈরি করে রেলভবনে প্রস্তাবনা আকারে পাঠানো হয়েছে। এ লাইনে তিনটি ট্রেন পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের। মূলত ট্যুরিস্ট কার ক্রয় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ধীরগতিতে হওয়ায় একাধিক ট্রেন সার্ভিসের পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। বাণিজ্যিকভাবে এ রেলপথটি লাভবান হবে- এ বিষয়টি মাথায় নিয়েই পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বাণিজ্যিক ও অপারেশন বিভাগ তাদের প্রস্তাবনা দিয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে।

তারা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে এই পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ট্রেনের চাহিদা বাড়বে। সরকারের এই মাইলফলক প্রকল্পটি কক্সবাজারসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা আরও পাল্টে দেবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। পরিবহন ব্যয় সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও আরামদায়ক হিসেবে রেলকে গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পটি গ্রহণ করেন, যা সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে অগ্রাধিকারভুক্ত।
এ প্রকল্পের আওতায় ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিংসহ বিভিন্ন আধুনিক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পর্যটকরা যাতে স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সমুদ্র সৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারে এ ব্যবস্থাটাও করা হয়েছে। সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা এলাকায় ২৯ একর জমিতে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনটি দেখতে এখনই অনেক দর্শনার্থী ভিড় করছেন। দৃষ্টিনন্দন স্টেশনটি ইতালি, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে এখন চলছে শেষ সময়ের ফিটিংসের কাজ।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন করেছেন রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর। তিনিও সেদিন সাংবাদিকদের জানান, এখন সরাসরি ঢাকা টু কক্সবাজার ট্রেন চলাচল শুরু হবে না। প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। বছরের শেষ দিকে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। কালুরঘাটের পুরনো যে সেতু সেটিও সংস্কার করে মজুবত করা হচ্ছে ট্রেন চলাচলের জন্য, যা অক্টোবরের মধ্যে সংস্কারকাজ সম্পন্ন হবে।পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ট্রেনে ভ্রমণের স্বপ্ন ১৩৩ বছর আগের। শত বর্ষের সেই পুরনো স্বপ্ন এখন বাস্তবে। আগামী ১৫ অক্টোবর দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে সেই পুরনো স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে, যা বর্তমান সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আরেকটি মাইলফলক বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রথম ১৮৯০ সালে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, যা মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার কথাছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব্য হয়নি। ১৩৩ বছর পর এখন তা বাস্তবায়ন করেছে বর্তমান সরকার। ২০১০ সালে দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথটি নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৯২ শতাংশ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আগামী অক্টোবরের শেষ দিকে রেলপথটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে কক্সবাজারের রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু মিয়ানমারের আগ্রহের অভাবে দ্বিতীয় অংশের কাজ এখনো শুরু হয়নি বলে প্রকল্পের সূত্র জানায়।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারকে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই রেলপথটি নির্মাণ করা হচ্ছে।এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘আগামী ১৫ অক্টোবর দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে পরীক্ষামূলক একটি ট্রেন চলাচলের বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা একটি ট্রেন পরিচালনা করব। কিছুদিন হলো আমি প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছি।’ তাই আগামী কয়েকদিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন শেষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।ঢাকা-কক্সবাজার রুটে আধুনিক ট্রেন সার্ভিস ॥ প্রকল্প সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন করে ১০২ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনের কাজ বর্তমানে প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পের নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এখন ট্রেন ট্রান্স এশিয়ান আন্তর্জাতিক রেলওয়ে রুটের অংশ হিসেবে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ১০২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে।প্রকল্পটির আওতায় দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে রামু থেকে ঘুমধুম সীমান্ত পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে না। তাই প্রকল্পের দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার পর্যন্ত নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া এক হাজার ৩৯১ কিলোমিটার ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

প্রকল্পে কম্পিউটার বেজড ইন্টারলক সিগন্যালিং সিস্টেম, ৩৯টি মেজর (বড়) ও ১৪৫টি মাইনর (ছোট) রেল সেতু এবং ৯৬টি লেভেলক্রসিং ও দুটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া রামু ও আশপাশের এলাকায় হাতির অভয়ারণ্য। ওই এলাকায় বুনোহাতি প্রায়শই দল বেঁধে চলাচল করে। অনেক সময় হাঁতি শুঁড় তুলেও পথ চলে। এ ক্ষেত্রে রেলপথ যাতে হাতির চলাচলে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করে, সে জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। এ জন্য রেলপথে বিশেষ ধরনের সেন্সর বসাতে হয়েছে। এতে কখনো হাতি রেলপথে থাকলে ট্রেনচালক ওই এলাকা অতিক্রমের আগেই তা বুঝতে পারবেন। হাতির বিষয়টি মাথায় রেখে জমির প্রয়োজন কিছুটা বাড়ানো হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত উন্নতমানের ট্রেন চলবে। ট্রেনের বেশিরভাগ কোচ থাকবে এসি। এই রেলপথে পাঁচটি স্টেশন হবে আধুনিক। এর মধ্যে কক্সবাজার স্টেশনটি হবে ঝিনুক আদলে আইকনিক রেলস্টেশন। প্রকল্পটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, কারিগরি তথা সার্বিকভাবে লাভজনক হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারকে একটি পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেল চলাচল শুরু হলে দেশের পর্যটন শিল্পে ও অর্থনৈতিক খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে।’ অক্টোবরের শেষ দিকে প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।