আন্তর্জাতিক

অসহায়দের বিরুদ্ধে লাখো সেনা

হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের নবম দিন ছিল গতকাল। আগের কয়েক দিনের তুলনায় গতকাল বৃহস্পতিবার হামলার তীব্রতা কিছুটা কমলেও তারা স্থল, আকাশ ও নৌপথে সর্বাত্মক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল তারা গাজা সীমান্তে কয়েক লাখ সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে। উত্তর গাজার কাছে ইসরায়েলের বসানো কাঁটাতারের সীমানার ১০ থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আশকেলনে অবস্থান নিয়েছে এই ইসরায়েলি সেনারা। এদিকে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে সাধারণ বাসিন্দাদের সরে যেতে নতুন করে সময়ও বাড়ায় দেশটি। মনে করা হচ্ছে, হামাসের বিরুদ্ধে ভয়ংকর হামলার যেকোনো সময় শুরু করতে পারে ইসরায়েল।

এদিকে চলমান এই সংঘাতে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে ফিলিস্তিনিরা। জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েল অভিযানের নামে যা করছে তাতে গাজাকে নরকের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কারণ সেখানে পানি আর খাবারের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।ইরান আবারও ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছে, গাজায় বেসামরিক বাসিন্দাদের ওপর ইসরায়েলের অভিযান অব্যাহত থাকলে ওই অঞ্চলের ‘পরিস্থিতি একরকম থাকার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না’ তারা। ইরানের হুমকির মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে তাদের দ্বিতীয় রণতরী পাঠিয়েছে ভূমধ্যসাগরে। অন্যদিকে অবিলম্বে গাজার সংঘাত বন্ধে দুপক্ষকেই যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল হয়তো এবার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান বন্ধ করবে না। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল আবারও হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় দক্ষিণ গাজায় পানি সরবরাহ শুরুর করার বিষয়ে ইসরায়েল রাজি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।আলজাজিরা বলছে, গত আট দিনে গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় অন্তত ২ হাজার ৪৫০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৮০০ জনই শিশু। ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৪ সালে ৫১ দিনের যুদ্ধে ফিলিস্তিনে যতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি মানুষকে এই আট দিনে হত্যা করেছে ইসরায়েল। অঞ্চলটিতে এ সময় আহত হয়েছে ৯ হাজার ২০০ জন। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরের অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গতকাল ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেশটিতে দুদিনের আগের সংখ্যার চেয়ে মৃত্যু বেড়েছে ১০০। নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, হামাসের হামলায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ ছাড়িয়েছে। আর ইসরায়েল থেকে ১২৬ জনকে ধরে এনে গাজায় জিম্মি করেছেন হামাস যোদ্ধারা।গতকাল ঘটনাস্থল থেকে বিবিসি সংবাদদাতা নিক বিক জানাচ্ছেন, সেনা অবস্থান ছাড়াও যুদ্ধবিমান আসা-যাওয়া ও নজরদারি ড্রোন চলাচলের মতো নানা ঘটনা ঘটছে সেখানে। তিনি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের বেশ কিছু যুদ্ধবিমান গাজার দিকে ক্রমাগত যাওয়া-আসা করছে। তবে এ অঞ্চলে বিমানের উপস্থিতি বাড়ানোর কারণ এখনো নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে না। যদিও শনিবার সারা রাতই গাজা এলাকায় বিমান হামলা হয়েছে। ইসরায়েল এরই মধ্যে তাদের রিজার্ভে থাকা কয়েক লাখ সৈন্যকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করেছে। গাজার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক ট্যাংকও অবস্থান নিয়েছে বলে বলা হচ্ছে।

গত শনিবার ওই অঞ্চলে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ও প্রস্তুতি দেখতে যান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছেন যে ‘সংঘাতের পরের পর্ব আসছে।এর আগে গত সপ্তাহে হামাসের আকস্মিক হামলার পর তিনি এক ভিডিও বার্তায় হুমকি দিয়েছিলেন যে ইসরায়েলি বাহিনী ‘পৃথিবী থেকে হামাসকে নিশ্চিহ্ন’ করে ফেলবে।সরায়েলি বাহিনী দুদিন ধরে গাজায় সর্বাত্মক হামলার হুমকি দিতে থাকলেও কখন এই হামলা শুরু হবে তা এখনো চূড়ান্তভাবে জানায়নি।ত্তর গাজায় হামাস ঘাঁটিতে হামলা করার আগে সেখান থেকে বেসামরিক বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার জন্য কয়েক দফায় সময়ও বেঁধে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেসামরিক বাসিন্দাদের দক্ষিণে সরে যেতে শুক্রবার নির্দেশনা দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। ওই সময়সীমা পার হওয়ার পর শনিবার আরও ছয় ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় দুটি নির্দিষ্ট রাস্তা ব্যবহার করে উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে সরে যাওয়ার জন্য।

এরপর গতকাল সকালে আবারও তিন ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয় বেসামরিক বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার জন্য। প্রাথমিকভাবে এই সময়সীমা ছিল স্থানীয় সময় দুপুর ১টা (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা) পর্যন্ত। তবে সবশেষ খবর পর্যন্ত তারা আরও ৪০ মিনিট বাড়িয়েছে এই সময়সীমা।বেসামরিক বাসিন্দাদের পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে উত্তর গাজার হাসপাতালগুলো খালি করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলি সেনাদের পক্ষ থেকে।

কিন্তু ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট কমিটি শনিবারই জানিয়ে দেয় যে তারা অসুস্থ ও আহতদের সেবা দিতে থাকায় হাসপাতাল খালি করে যেতে পারবে না।দাতব্য সেবা সংস্থা মেডিসাঁ সাঁ ফ্রঁতিয়ের নির্বাহী পরিচালক ডা. নাটালি রবার্টস মন্তব্য করেছেন যে, কয়েক ঘণ্টার নোটিসে গাজার হাসপাতাল থেকে সরে যাওয়া ‘অসম্ভব’। তিনি বলছেন, ‘তাদের যাওয়ার কোনো জায়গাই নেই। গাজার দক্ষিণের হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণ ভরে গেছে। তা ছাড়া পুরো গাজাতেই এখন কোনো বিদ্যুৎ নেই।এ ছাড়া দক্ষিণ গাজার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্থান সংকুলান করাও কঠিন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। হাসপাতাল খালি করার নির্দেশনাকে রোগীদের জন্য ‘মৃত্যুদণ্ড’র শামিল হিসেবে মন্তব্য করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত শনিবার ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ২৮ জন চিকিৎসা সেবাদানকারী মারা গেছে। তারা আরও জানিয়েছে, গাজার দুটি হাসপাতালে কোনো সেবা দেওয়া যাচ্ছে না এবং ১৫টি মেডিকেল সেন্টার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এদিকে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধবিমান বহনকারী আরেকটি রণতরী পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন শনিবার জানান, ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হামলা স্তিমিত করতে ও হামাসের হামলাকে ঘিরে ওই অঞ্চলে যুদ্ধের বিস্তার থামাতে’ এই রণতরী পাঠানো হয়েছে।

গত সপ্তাহে হামাস ও ইসরায়েলি বাহিনীর এই সংঘাত শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে একটি রণতরী পাঠায়। নতুন পাঠানো রণতরী ইউএসএস আইজেনহাওয়ার আগে থেকে অবস্থান করা রণতরী ইউএসএস ফোর্ডের সঙ্গে যোগ দেবে।গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণে যেন বেসামরিক বাসিন্দারা হতাহত না হয়, সে বিষয়ে জোর দিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে শনিবার ফোনে আলোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।গাজায় বেসামরিক বাসিন্দাদের জন্য ত্রাণ ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাইডেন প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) নেতা মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন।

অন্যদিকে গাজায় বেসামরিক বাসিন্দাদের ওপর ইসরায়েলের অভিযান অব্যাহত থাকলে ওই অঞ্চলের ‘পরিস্থিতি একরকম থাকার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না’ বলে সতর্ক করেছে ইরান। কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়ের সঙ্গে দেখা করার পর ইরানের গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দুল্লাহিয়ান। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স হামাসের এক বিবৃতির বরাত দিয়ে খবরে প্রকাশ করেছে যে হামাসের লক্ষ্য অর্জনে ইরান সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

আরও খবর

Sponsered content