সারা দেশ

এবার রাজধানীর যানজট বাড়বে

এবার রাজধানীর যানজট বাড়বে

ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে রাজধানীর চলাচল সহজ করতে রামপুরা-ডেমরা সড়কে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বমোট খরচ হবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এই প্রকল্পে ঢাকার বিভিন্ন মাস্টারপ্ল্যান বিবেচনায় আনা হয়নি। ফলে এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে-এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, যান চলাচল সহজ করতে এই প্রকল্প নেওয়া হলেও ফলাফল হবে উলটো, বাড়বে রাজধানীর যানজট। কারণ এক্সপ্রেসওয়েতে দ্রুতগতিতে গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করবে। পাশাপাশি ঢাকার ভেতরের গাড়িগুলোর চলাচলও একই সড়কে অব্যাহত থাকবে।

বাড়ানো হচ্ছে না সড়কের প্রশস্ততা অথবা তৈরি করা হচ্ছে না বিকল্প কোনো সড়ক। ফলে ঢাকার প্রগতি সরণি ও হাতিরঝিল কার্যত যানজটে স্থবির হবে। যার প্রভাবে অন্য সড়কগুলোতে গাড়ির জট বাঁধবে। বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম জটিল শহর। জনঘনত্ব, যানজট, বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের কারণে এখানে কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে সামগ্রিকতা বিবেচনা করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উদ্যোগী সংস্থা প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সেসব বিবেচনা করেনি। এছাড়া ঢাকা ও আশপাশের এলাকার যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণে কী ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে তার সুনির্দিষ্ট মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) সেসব বলা হয়েছে।

সেখানে রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা সড়কের এক্সপ্রেসওয়ের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। রাজউকের ঢাকা শহরের মহাপরিকল্পনা ড্যাপেও কোনো নির্দেশনা দেওয়া নেই। এরপরও কীভাবে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।অনুসন্ধানে জানা যায়, রামপুরা-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে আবেদন করে। এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দুই সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসি জানিয়েছে, এটা বাস্তবায়ন করলে রামপুরা খাল ভরাট হয়ে যাবে।

পাশাপাশি প্রগতি সরণি ও হাতিরঝিল যানজটে স্থবির হয়ে পড়বে। ডিএসসিসিও প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা জানিয়েছে, ঢাকা শহরের মধ্যে এমন প্রকল্পের এই মুহূর্তে তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। দুই সিটি ও রাজউকের সঙ্গে সড়ক ও জনপথ বিভাগ দফায় দফায় সভা করলেও এখনো অনুমোদন নিতে পারেনি।অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর থেকে দুই সিটিকে বলা হয়েছে-প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার চায়নার সঙ্গে চুক্তি করেছে। এটার অনুমোদন না দিলে সরকার বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে সহায়ক প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।

পরে যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে প্রকল্প বাস্তবায়নের খরচ কয়েকগুণ বাড়বে। তবুও ঢাকার দুই সিটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে না।এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক যুগান্তরকে বলেন, রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে কারিগরি মূল্যায়ন করলে প্রমাণিত হবে যে, এটা এক ধরনের পাগলামি ও অর্থহীন উদ্যোগ। এটা শুধু বাংলাদেশ বলে সম্ভব হচ্ছে, যেখানে ন্যূনতম বিজ্ঞান চর্চা হয় সেসব দেশে এটার চিন্তাও করা হয় না।তিনি বলেন, দেশে এমন অর্থহীন কাজ অহরহ হচ্ছে। সবারটা যদি হয়, তাহলে সড়ক ও জনপথেরটা হবে না কেন? এজন্য তারাও নেমে পড়েছে। এই এক্সপ্রেসওয়েতে চিটাগাং রোডের গাড়ি হাতিরঝিল ও প্রগতি সরণিতে নামবে। এতে এই সড়ক যানজটে স্থবির হয়ে পড়বে।

কেননা এই অংশে এখনই যানজটে স্থবির থাকছে; সড়কের প্রশস্ততা না বাড়িয়ে এই সড়কে আরও গাড়ি নামানো হলে কোনো সুফল মিলবে না তা সহজেই বোঝা যায়। কোনো সড়ক না বাড়লেও দুপাশে মার্কেট, বিশ্ববিদ্যালয়সহ একের পর এক বহুতলা ভবন, কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থায় নতুন করে এক্সপ্রেসওয়ের দ্রুতগতির গাড়ি এই সড়কে এসে স্থবির হয়ে পড়বে।তিনি আরও জানান, ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েগুলো খেয়ালখুশিমতো করা হচ্ছে। এ কারণে এখান থেকে সুফল মিলছে না। ৩০০ ফুটে ১৪ লেনের সড়ক তৈরি করা হয়েছে। আর দুপাশে সরু সড়ক। তাহলে এসব করে লাভ কী। আর শহরের মাঝখান দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

শহরকে বাইপাস করা দূরের কথা, শহরের নতুন নতুন যানজট স্পট তৈরি করছে এই এক্সপ্রেসওয়ে। বিশ্বের অন্য দেশগুলো ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে যেসব ভুল করেছে, ঢাকায় সেসব ভুল করা হচ্ছে।জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগরপরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা এক্সপ্রেসওয়ের নামে পরিকল্পনার প্রভাব বিশ্লেষণ ছাড়া সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। এটার উদ্দেশ্য কী? শহরের ট্রাফিক জ্যাম কমানো নাকি শহরকে বাইপাস করা; তা পরিষ্কার করা দরকার। বাইপাস হলে মূল শহরের ভেতর দিয়ে কেন যাবে।

তিনি বলেন, রামপুরা-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নে রামপুরা খাল ভরাট করতে হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছাড়াই এসব করা হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে আগে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, পরে তা বাস্তবায়নে সবাইকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এটা বাস্তবায়ন করা হলে সরকারের নানা ক্ষতি হবে-এমন অপকৌশল একদিকে শহরের ক্ষতি করছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থের অপচয় ঘটছে।তিনি জানান, ঢাকার মতো জটিল শহরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তেমন কোনো সুফল বয়ে আনবে না। বরং এটা দীর্ঘ মেয়াদে শহরকে বড় সমস্যায় ফেলছে।

সরকারি প্রকল্প গ্রহণ করা সংস্থাগুলো এসব প্রকল্প নেওয়ার আগে ঢাকা শহরের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপ, ঢাকা ও আশপাশের এলাকার পরিবহণ মাস্টারপ্ল্যানগুলো পর্যালোচনা করে গ্রহণ করা দরকার। কিন্তু এসব প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এসব দিক বিবেচনা করা হচ্ছে না।সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রামপুরা সেতু থেকে বনশ্রী-শেখের জায়গা-আমুলিয়া-ডেমরা মহাসড়কে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। চিটাগাং রোড মোড় এবং তারাবো লিংক মহাসড়কসহ করিডরটি চারলেনে উন্নীত করা হবে। ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটারের এই করিডরে ৯ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ৪ কিলোমিটার এট গ্রেডে নির্মিত হবে।

পাশাপাশি নিচে সার্ভিস লেনসহ চারলেনের এক্সেস কন্ট্রোল সড়ক নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের সিংহভাগ ঢাকা জেলায় পড়েছে। তবে অংশবিশেষ নারায়ণগঞ্জ জেলায় পড়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ফলাফল সম্পর্কে বলা হচ্ছে-এখনকার এক ঘণ্টার দূরত্ব ১০ মিনিটে নেমে আসবে।সওজ সূত্রে আরও জানা যায়, চায়না কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড এবং চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশন কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। পিপিপি চুক্তির আলোকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চায়না কনসোর্টিয়াম ২ হাজার ৯৪ কোটি ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করবে। পাশাপাশি সরকার এলিভেটেড প্রকল্প বাস্তবায়নের উপযোগী করতে ১ হাজার ২০৯ কোটি টাকা খরচ করছে। ২৫ বছরে চায়না পিপিপি ইনডেক্সের অ্যাভেইলেবিলিটি পেমেন্ট পদ্ধতিতে ৪২ কিস্তিতে বিনিয়োগের লভ্যাংশসহ বুঝে নেবে।

এক্ষেত্রে পিপিপি চুক্তির ইনডেক্স অ্যাভেইলেবিলিটি পেমেন্ট সূত্রানুসারে মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার দর, পারফরম্যান্স অনুসারে সমন্বয় করে পরিশোধ করতে হবে। বিশ্ববাজারে ডলারের দর বাড়ায় চায়নার প্রকল্প ব্যয় বাড়তে পারে। সে বিষয়ে তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। সেটাসহ প্রকল্পে টাকা ফেরত দেওয়া লাগবে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে প্রকল্পের টোল চায়নার বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আদায় করবে না। এটা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতায় আদায় করতে হবে।রামপুরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, রামপুরা-ডেমরা এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপিতে চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রামপুরা থেকে ডেমরা হয়ে চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিরাইল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।

এটা ঢাকার যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সড়ক যোগাযোগের নতুন গেটওয়ে তৈরি করবে। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেট রোড থেকে ঢাকায় দ্রুতগতিতে গাড়িগুলো প্রবেশ করে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি করবে জেনেও তার সমাধানের কোনো কৌশল তারা দিতে পারছে না।তারা আরও জানান, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পাশাপাশি নিচের ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সড়ক সার্ভিস লেনসহ ৪ লেনে উন্নয়ন করা হবে। এছাড়া ২টি সেতু, ৩টি ভেহিকেল আন্ডারপাস, ১টি টোল প্লাজা, ১২টি র‌্যাম্প ও ২টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রকল্পটি অনুমোদন করে সরকার। এই প্রকল্পের মেয়াদকাল আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত।

এ প্রকল্পের আওতায় ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণসহ সরকারি সংস্থার জমি হস্তান্তর করে ৬২ একর জমি পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত করা। সেবা সংস্থার সংযোগ লাইনগুলো স্থানান্তর করা। সেসব কার্যক্রম চলমান রয়েছে।প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য : জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং রামপুরা-ডেমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয় না। অনেক সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও হতে পারে। সেগুলো ভিন্নভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। মেট্রোরেল, বিআরটি, এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্য প্রকল্পগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন হলে তখন এসব প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে।

তিনি জানান, ঢাকা সিটির সমস্যার ক্যানসারে রূপ নিয়েছে। শুধু এক জায়গায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সব সমস্যার সমাধান মিলবে না। ক্যানসার হলে যেমন এক জায়গায় ট্রিটমেন্ট না দিয়ে সারা শরীরে কেমো দেওয়া হয়নি। ঠিক তেমনি ঢাকা শহরের পুরো এলাকার সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি নতুন করে বাইরের মানুষকে ঢাকায় না ঢুকিয়ে বাইরে রেখে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়, সেই কৌশল বের করতে হবে।