সারা দেশ

আমবাগানে মুকুলের খরা রাজশাহীর

আমপ্রধান রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের মাঝে একটা প্রবচন বেশ জনপ্রিয়। আমের আনা মাছের পাই, টিকে থাকলে কে কত খায়। আমগাছে ষোলো আনার মধ্যে এক আনা গুটি টিকলেই আমের ভরে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। আর মাছের পোনা এক পয়সা টিকলেই অনেক। কিন্তু এবার ভরা মৌসুমেও আমগাছগুলোতে আশানুরূপ মুকুল আসেনি।আম রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। বাগানগুলো মুকুলিত না হওয়ায় চাষিদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। তারা শেষ চেষ্টা হিসেবে শেষ সময়ে বাগানগুলোতে কীটনাশক ছেটাচ্ছেন।

গাছের গোড়ায় সেচ দিচ্ছেন।এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষিরা বলছেন, এবার রাজশাহী অঞ্চলে শীতকাল বেশ প্রলম্বিত হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে কখনো মাঝারি আবার কখনো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ছিল। একটানা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলে সূর্যের আলো পড়েনি প্রকৃতিতে। সঙ্গে ছিল উত্তর থেকে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। স্বাভাবিক নিয়মে আমবাগান মুকুলিত হওয়ার জন্য যে পরিমাণ তাপমাত্রার দরকার হয়, তা এবার ছিল না।

চাষিদের আরও শঙ্কা এবার আমের ফলন বিপর্যয় ঘটতে পারে।আমচাষিরা আরও বলছেন, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শীতের বিদায় হওয়ার কথা থাকলেও রাজশাহী অঞ্চলে শীত দীর্ঘায়িত হয়েছে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। এই সময়ে দিনের তাপমাত্রায় উত্তাপ বেশ কম ছিল। মাঝে দুই দফা হালকা বৃষ্টি হওয়ায় গাছের ডগায় যে আঠা ছিল তাও ধুয়ে গেছে। গাছের ডগায় থাকা আঠা আমগাছ মুকুলিত হওয়ার জন্য সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে। সব কিছু মিলিয়ে এবার আমগাছগুলোতে মুকুলের চিরাচরিত সমারোহ নেই।

ফলে চলতি মৌসুমে আমের ফলন নিয়ে চাষিরা হতাশ। অনেক মৌসুমি বাগান ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।রাজশাহী কৃষি অঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, আম রাজশাহী অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী ফসল হলেও গত এক দশকে পুরো অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আমবাগানের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। এখন মানুষ অনেক বেশি সচেতন। বাড়ির আঙিনা বা বাসাবাড়ির পেছনে থাকা পুকুর পাড় ও খালি জায়গাতেও আমগাছ লাগাচ্ছেন। প্রজেক্ট তৈরি করে বিশালায়তনের আমবাগান করা হচ্ছে। ফলে রাজশাহী অঞ্চলের সর্বত্র আম হয়ে উঠেছে প্রধান অর্থকরী একটি ফসল।

গত মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চলে ১০ হাজার কোটি টাকার আম উৎপাদন হয়েছে।রাজশাহী কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর আমবাগান থেকে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৯১২ টন আম উৎপাদিত হয়। ফলন আশানুরূপ হওয়ায় গত বছর আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩৭ হাজার ৮০০ হেক্টর আমবাগান থেকে ৪ লাখ ৯৮ হাজার টন আমের ফলন হয়েছিল। চাষিরা আমের ভালো দামও পেয়েছিল।চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. পলাশ সরকার বলেন, গত মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ভালো ফলন হয়েছিল। এ বছর বাগানগুলোতে মুকুল কিছুটা কম দেখা যাচ্ছে। তবে এখনো মুকুল ফুটছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে গাছে মুকুল আসতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। চাষিরা বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জেলা। আমের ফলন কম হবে— এমন কথা এখনো বলার সময় আসেনি।অন্যদিকে নওগাঁতে এবার ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর আমবাগান থেকে গত বছর রেকর্ড ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩৫ টন আম ফলন হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওগাঁর আমপ্রধান এলাকা সাপাহার ও পোরশার বাগানগুলোতে এবার মুকুল কম। নওগাঁ জেলার অধিকাংশ আমবাগান হাইব্রিড জাতের। কিছু বাগানে এখনো মুকুল ফুটছে।

এদিকে রাজশাহী অঞ্চলের আরেক জেলা নাটোরে ৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর আমবাগান থেকে গত মৌসুমে ১ লাখ ৩ হাজার টন আমের ফলন হয়েছিল।চলতি মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চলের আমবাগানগুলোতে স্বাভাবিক মুকুল না আসা প্রসঙ্গে রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শামসুল ওয়াদুদ বলেন, এবার আবহাওয়ার কিছুটা হেরফের হওয়ায় বাগানগুলোতে মুকুল আসতে বিলম্বে হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাগানে মুকুল এসেছে। মুকুলিত হওয়ার আরও সময় আছে। আশা করি ফলন বিপর্যয় হবে না।

%d bloggers like this: