বিনোদন

নেই এক যুগে হুমায়ুন ফরীদি

নেই এক যুগে হুমায়ুন ফরীদি

বসন্তের আগমনে শহরের চারদিকে রঙ বেরঙের ছড়াছড়ি থাকলেও এইসব রঙের মাঝে নেই একজন হুমায়ুন ফরীদি! মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের সবস্তরে তিন দশকের পদার্পণ ছিল তার। অভিনয়ের মাধ্যমে আমৃত্যু ছড়িয়েছেন জীবনের বর্ণীল আলো। অথচ তার ব্যক্তিজীবনটা ছিল পুরোটাই সাদামাটা। ঠিক বারো বছর আগে মাত্র ৬০ বছর বয়সে ফাল্গুনের প্রথম দিনটিতে সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন দেশের অগণিত মানুষের প্রিয় এই অভিনেতা।

কিছু মানুষ আছেন যারা তার চলে যাওয়া এখনো মানতে নারাজ। অন্তত তাদের জন্য মন খারাপের দিন আজ। চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও টেলিভিশনে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। তাকে বলা হতো অভিনয় কারিগর। বাংলাদেশের নাট্য ও সিনেমা জগতে তিনি অসাধারণ ও অবিসংবাদিত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।

একজন হুমায়ুন ফরীদি বারবার জন্মায় না। তার মতো শিল্পী জন্মাতে যুগ যুগ সময় লাগে, শতাধিক বছর লাগে। একজন প্রকৃত অভিনেতা মনে হয় তিনিই যিনি মঞ্চ, নাটক, সিনেমা- সব জায়গাতেই দক্ষতার সাথে অভিনয় করতে পারেন আর মানুষের মন জয় করতে পারেন। কানকাটা রমজান থেকে নব্বই দশকের একের পর এক ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক সিনেমা- সব জায়গাতেই ফরীদি সফল।

দহন, একাত্তরের যীশুর মতো ভিন্ন ধরনের সিনেমাতেও তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।ছোটপর্দাতেও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারাকে তিনি আনন্দিত করে তুলেছিলেন। ফরিদীর নাটক মানেই বিটিভির সাদাকালো পর্দায় পুরো বাঙালির চোখ আটকে যাওয়া। হতাশ করতেন না তিনি! এতো প্রানবন্ত, এতো জীবন্ত, যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই জীবন্ত হয়ে যেতো ফরিদীর অভিনয়ে!

আর ‘সংশপ্তক’ নাটকে হুমায়ূনের ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রের অভিনয় যারা দেখেছেন তারা ফরিদীকে স্থান দিয়েছেন হৃদয়ের একেবারে মাঝখানে।বর্ষীয়াণ অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান এই গুণী অভিনেতার সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, তার সঙ্গে অনেক ছবিতেই কাজ করা হয়েছে আমার। কাজের ফাঁকে কিংবা কাজের বাইরেও তার সঙ্গে আড্ডা হত। আড্ডার সময় তিনি একাই পুরো আসর জমিয়ে রাখতেন। সবসময়ই হাসি খুশি থাকতেন আর সবাইকে হাসাতেন। তার অনেক কষ্ট ছিল মনে কিন্তু সেগুলো কখনো প্রকাশ করেন নি।

নিজে হজম করেছেন সব। তিনি অনেক বড় মাপের একজন অভিনেতা। তিনি যখন অভিনয় করতেন তখন হাত নাড়তেন, পুরো শরীর দোল দিত। তার পুরো শরীরেই অভিনয় ফুটে উঠতো। তার মত এতো বড় অভিনেতা জীবনে দেখিনি। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছেন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কখনও পরিচয় দেননি তিনি। তার এ ঋণ কখনো শোধ হবার নয়।

১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেওয়া ফরিদী মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তুমুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমীদের হৃদয়ে আসন গেড়ে নেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র ‪‎বারো‬‬‬‬ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক ‘ প্রথম অভিনয়ে করেন। রক্তে ছিলো অভিনয়, সূর্যের মতো আলো তো তিনি একদিন ছড়াবেনই।

ফরীদি অভিনীত নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭-৮৮) ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২),‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘বকুলপুর কতদূর’ (১৯৮৫)’, ‘একদিন হঠাৎ’ (১৯৮৬), ‘ও যাত্রা’ (১৯৮৬) ‘মহুয়ার মন’ (১৯৮৬), ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’ (১৯৮৬) ‘পাথর সময়’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’ (১৯৯৩), ‘চন্দ্রগ্রন্থ’ (২০০৬), ‘কাছের মানুষ’ (২০০৬), ‘কোথাও কেউ নাই’ (১৯৯০), ‘মোহনা’ (২০০৬), ‘ভবেরহাট’ (২০০৭), ‘জহুরা’,‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘শৃঙ্খল’ (২০১০), ‘প্রিয়জন নিবাস’ (২০১১), ‘অক্টোপাস’, ‘আরমান ভাই দি জেন্টেলম্যান’ (২০১১)-আরো আরো অনেক নাটকে বিরামহীনভাবে দর্শকদের হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২), ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ (১৯৮৩), ‘ভবের হাট’ (২০০৭), ‘শৃঙ্খল’ (২০১০) ইত্যাদি।

নব্বই দশকে এসে নাম লিখিয়েছিলেন ‘বানিজ্যিক ধারার বাংলা ছবিতে। ‘হুলিয়া’ দিয়ে প্রথম সিনেমাতে অভিনয়। ফরিদী অভিনয়ে এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে একসময় নায়কের চেয়ে বাংলা সিনেমা প্রেমী জাতির কাছে ভিলেন হুমায়ূন ফরিদী বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন। হলে তাঁর সিনেমা মুক্তি মানেই ওপচে পরা ভীড়! সেলুলয়েড়ের বিশাল পর্দায় ফরিদীর উপস্থিতি মানে দর্শকদের মুহুর্মুহু তালি। একটু একটু করে বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটাও যেন পরিবর্তন হতে থাকে।

দহন, আনন্দ অশ্রু, বিচার হবে, মায়ের অধিকার, একাত্তরের যীশু, ভন্ড, পালাবি কোথায়, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, হিংসা, বিশ্ব প্রেমিক, অপহরণের মতো জনপ্রিয় এবং একই সাথে বানিজ্যিকভাবে সফল ২৫০ টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত অন্যান্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘কন্যাদান’ (১৯৯৫), ‘আঞ্জুমান’ (১৯৯৫), ‘দুর্জয়’ (১৯৯৬), ‘শুধু তুমি’ (১৯৯৭), ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’. ‘বিদ্রোহ চারিদিকে, ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘রূপকথার গল্প’ (২০০৬), ‘আহা!’ (২০০৭), ‘প্রিয়তমেষু’ (২০০৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

জাত অভিনেতা ছিলেন হুমায়ুন ফরিদী, রক্তে মিশে ছিলো অভিনয়, নাট্য জগতের সবাই বুঝে ফেলেছিল ধূমকেতুর জন্ম হয়েছে, একদিন শাসন করবে এই যুবক। সেদিনের হিসেব এক চিলতেও ভুল হয়নি, এরপর টানা তিন দশক তার ক্যারিশম্যাটিক, তার ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো বাঙালি অভিনয় প্রিয় জাতিকে।