29 January 2024 , 5:28:58 প্রিন্ট সংস্করণ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য উত্তপ্ত। সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বার্ষিকী সামনে রেখে সশস্ত্রগোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে সেনাবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছে। অসমর্থিত সূত্রের খবর, যুদ্ধে চলতি সপ্তাহে ১২ থেকে ১৫ জন নিহত হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে চীন মধ্যস্থতা করে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধবিরতির বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।এদিকে রাখাইন রাজ্যে অস্থিতিশীলতার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্ত এলাকায় সতর্কতা বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ।
রোববার (২৮ জানুয়ারি) সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান। মিয়ানমারে গোলাগুলির শব্দে সীমান্তে বাংলাদেশ অংশে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।নোবেলজয়ী অং সান সু চির সরকারকে সরিয়ে দিয়ে ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে নেয় দেশটির সেনাবাহিনী।এরপর থেকে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সম্প্রতি সশস্ত্র আরাকান আর্মি হামলা চালিয়ে সেনাবাহিনীর অনেক চৌকিই দখলে নিয়েছিল। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এতদিন এসব হামলায় বলতে গেলে তেমন কোনো বাধাই দেয়নি। কিন্তু জান্তার ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বার্ষিকী সামনে রেখে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান শুরু করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী একযোগে বিমান, জাহাজ এবং স্থল অভিযান চালানোর পর ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের একটি গ্রামে রোহিঙ্গাদের পেছনে অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের তারা মূলত ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে।এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী স্থল অভিযানে আরাকান আর্মিকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলে সংঘর্ষের মাঝখানে কয়েকজন রোহিঙ্গা মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংস্থা ইউএনএইচসিআর তাদের অ্যাম্বুলেন্সে হতাহতদের সরিয়ে নিয়েছে।এমন দৃশ্য থেকে ধারণা করা হচ্ছে, নিহতরা মিয়ানমারে অবস্থানরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গা সদস্য।
তবে এসব তথ্যের কোনো কিছুই জান্তা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া নয়। যুদ্ধের কোনো তথ্য দেয় না জান্তা। জান্তাবিরোধীরা ইরাবতিসহ বিভিন্ন অনলাইন পরিচালনা করে কিছু তথ্য দিয়ে থাকে।এদিকে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এতে অপরাপর ইস্যুর পাশাপাশি রাখাইন সংকট নিয়েও আলোচনা হয়েছে।বৈঠকের পর চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে চীন যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে চীন মধ্যস্থতার মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীন চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।তবে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি লুইস গুয়েন বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের এখন উপযুক্ত সময় নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গুয়েন বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি। তবে এখন তাদের ফেরত পাঠানোর উপযুক্ত সময় নয়।রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সতর্ক অবস্থায় আছে।
সাধারণভাবে মনে করা হয়, রাখাইন রাজ্যে উত্তেজনা বিরাজ করলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করে। বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগও নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এমন আশঙ্কা থেকে সীমান্তে এ সতর্ক অবস্থান। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউ বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করেছে বলে জানা যায়নি।পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অবশ্য বলছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি কখনো ভালো, কখনো খারাপ থাকে। বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্য খারাপ হওয়ায় এ মুহূর্তে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে তারা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। মন্ত্রী সম্প্রতি উগান্ডায় ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। জান্তা ক্ষমতা দখলের তৃতীয় বার্ষিকীতে নিজেদের শক্তির জানান দিতে শান থেকে এবার রাখাইনে অধিক মনোযোগে দিয়েছে। রাখাইন আর্মির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে। তবে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা সম্ভব হলে পুনরায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা পুরোদমে সচল হবে।
সীমান্তে বিজিবি মহাপরিচালক : কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। কিন্তু এ সংঘর্ষের রেশ উড়ে এসে পড়েছে কক্সবাজার সীমান্তে। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ভারী মর্টার ও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী গ্রামবাসীরা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে সীমান্ত এলাকা ত্যাগ করেছেন।
বিজিবি সূত্র বলছে, শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকালে মিয়ানমার থেকে ১৩ মর্টার শেল ও ১ রাউন্ড বুলেট বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্তে এসে পড়েছে। এ ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে বিজিপির কাছে লিখিত প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।মর্টার শেল ও বুলেট এসে পড়া সীমান্তের দায়িত্বে ছিল কক্সবাজার ব্যাটলিয়ন-৩৪ বিজিবি।রোববার (২৮ জানুয়ারি) বিকালে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক কর্নেল মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান সীমান্ত পরিদর্শনে এসেছেন।
বিজিবি মহাপরিচালক বুলেট ও মর্টার শেল পড়ার স্থানটি পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি পালংখালী, তুমব্রু এবং হোয়াইক্যং বিওপি পরিদর্শন করে এবং মায়ানমারের চলমান সংঘর্ষ ও প্রতিপক্ষের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রাখতে বিজিবিকে সীমান্ত এলাকায় সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন বলেও জানানো হয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।এছাড়াও মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পেশাদারির সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে বিজিবি সদস্যদের নির্দেশ দেন মহাপরিচালক।
আতঙ্কিত স্থানীয়রা : শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বাংলাদেশ অংশে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড উলুবনিয়া এলাকায় স্থানীয় নুরুল ইসলামের বসতঘরে এসে পড়ে এলএমজির গুলি। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে সীমান্ত এলাকার মানুষের। অনেকে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, শনিবার আমি নিজেও গুলির আওয়াজ শুনেছি। আমার এলাকার একটি ঘরেও গুলি এসে পড়েছে। আমরা খবরাখবর নিয়েছি। সীমান্ত এলাকার মানুষজন এখন আতঙ্কে আছেন। সকাল থেকে বিজিবিসহ অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্ত এলাকায় এসেছে।তিনি বলেন, বিজিবসহ অনেক বাহিনী সীমান্ত এলাকায় এখন টহল দিচ্ছে। এরকম অবস্থা হলে একটু শান্তি পাবে এলাকার মানুষ।
এ বিষয়ে টেকনাফ-২ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রতিবেশী দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাত চলমান থাকায় মিয়ানমার সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার আছে এবং এখন সীমান্তের কাছাকাছি সংঘর্ষ চলছে বলে তা আরও জোরদার করা হয়েছে।