ধর্ম

আল্লাহকে পাওয়ার সাধনায় হজ ও কোরবানি

হিজরি বর্ষের শেষ মাস জিলহজ। কোরআন-হাদিস অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর কাছে অত্যন্ত মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস জিলহজ। এ মাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে রাসুল (সা.)-এর ঐতিহাসিক বিদায় হজের স্মৃতি। এ মাসেই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে সারা বিশ্বের সক্ষম ও সামর্থ্যবান মুসলমানরা পবিত্র হজ পালন করেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশে ওই গৃহের হজ করা তার জন্য অবশ্যক।

আর যে এই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করে, তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান ৯৭)মহান আল্লাহর নিকট একনিষ্ঠভাবে আত্মসমর্পণের উদ্দেশে সমবেত লাখ লাখ মুমিনের কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে শেষ নবী মুহিাম্মদ (স.)-এর প্রিয় জন্মভূমি মকবকা মুকাররমা। সবার পরনে একই ধরনের সাদা কাপড়, সবার কণ্ঠে এক আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা এবং একই তরিকায় মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় তাকওয়া ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনুপম পরিবেশ।

আধ্যাত্মিক চেতনায় দীপ্তিমান হয়ে ওঠে মুমিনের আত্মা। তাওহিদি চেতনায় মহান প্রভুর সান্নিধ্যে বান্দার আত্মসমর্পণের কী এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এ মাসে রয়েছে ইসলামের আরও দুটি শাশ্বত বিধান। তা হলো ঈদুল আজহা ও কোরবানি। যা মুসলিম উম্মাহর মাঝে তাকওয়ার অনুভূতি জাগ্রত করে। আর ইমানি স্পৃহাকে করে অধিকতর শানিত। সর্বোপরি কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের অন্যতম ঐতিহ্য। ঈদুল আজহা ত্যাগ আনন্দ ও সম্প্রীতির একটি উপলক্ষ। তাই কোরবানি ও ঈদুল আজহার তাৎপর্য, শিক্ষা ও মাসআলা জেনে সে অনুযায়ী আমল করা মুমিন-মুসলমানদের জন্য অবশ্য করণীয়।

কোরবানি আরবি শব্দ। এর অর্থ নৈকট্য, উৎসর্গ, বিসর্জন, ত্যাগ ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখের যে কোনো দিন আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ত্যাগ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানদের দ্বারে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল আজহা। এ দিন সকালে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের পর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে সামর্থ্যবান মুসলমানরা শরিয়ত অনুমোদিত পশু কোরবানি করেন।

প্রাপ্ত বয়স্ক, জ্ঞানবান, স্বাধীন ও মুকিম (মুসাফির নয় এমন) মুসলিম নর-নারী যদি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদেক থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাওসার ০২) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, কোরবানি ঈদের দিন কোরবানির চেয়ে উত্তম ও প্রিয় কোনো আমল নেই। কিয়ামত দিবসে কোরবানির পশুর শিং, পশম, খুর ইত্যাদি উপস্থিত হবে এবং কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই মহান আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়।

তাই তোমরা আনন্দচিত্তে কোরবানি করো। (তিরমিজি) একদা কোরবানি নিয়ে আলোচনা উঠলে সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন কোরবানি কী? উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, কোরবানি হলো তোমাদের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন এতে আমাদের জন্য কী বিনিময় রয়েছে? রাসুল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, তাহলে ভেড়ার হুকুম কী? রাসুল (সা.) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে সওয়াব রয়েছে। (ইবনে মাজাহ)

হাদিসের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। (মুসনাদে আহমদ) তাই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানির মতো এই মহিমান্বিত ইবাদত থেকে বিরত থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সর্বোচ্চ ইখলাস ও তাকওয়ার অনুভূতি নিয়ে কোরবানির মতো তাৎপর্যপূর্ণ আমলটি পালন করা সামর্থ্যবান মুসলমানদের ইমানি কর্তব্য ও দায়িত্ব।হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর ইমানদীপ্ত সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহর জমিনে ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচু করার জন্য নিজেদের জান ও মাল কোরবানিসহ সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে কঠিন থেকে কঠিনতম কষ্টও মেনে নিতে হবে।

এটিই কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য ও শিক্ষা। এই শিক্ষা ধারণ করতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি দিয়ে আত্মাকে করতে হবে পরিশুদ্ধ ও নির্মল। তখনই অন্তরে জাগ্রত হবে তাকওয়া তথা খোদাভীতি। সেই খোদাভীতিই হলো কোরবানি থেকে আল্লাহর একমাত্র চাওয়া। এ প্রসঙ্গে কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিকট কোরবানির গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না। তার কাছে পৌঁছে একমাত্র তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ ৩৭।)  পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর তাকওয়া ও আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় স্মৃতিস্মারক। এই ঈদ আমাদেরকে ভোগ-বিলাসিতার মানসিকতা পরিহার করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে ঈদুল আজহা আমাদের মাঝে জাগিয়ে তোলে মানবিক সম্প্রীতি ও নৈতিক চেতনাবোধ। দূর করে দেয় হিংসা-বিদ্বেষের প্রবণতা। ছড়িয়ে দেয় সাম্য, শান্তি ও সৌহার্দের বার্তা। অটুট করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এটাই ঈদুল আজহার মূল তাৎপর্য। এ তাৎপর্যের মহিমায় মানবজীবন আলোকিত হলেই সব অনাচার, দুরাচার ও পাপাচার সমাজ থেকে দূর হবে। নির্মল হবে মানবাত্মা। পরিশুদ্ধ হবে সমাজ ব্যবস্থা। আসুন হজ, কোরবানি ও ঈদুল আজহার প্রকৃত তাৎপর্য ও শিক্ষার আলোয় আলোকিত করি নিজেদের জীবনধারা। মহান আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।