ধর্ম

যে অবস্থায় ছিলেন ইউনুস (আ.) মাছের পেটে

যে অবস্থায় ছিলেন ইউনুস (আ.) মাছের পেটে

হজরত ইউনুস (আ.) একজন সম্মানিত নবী। কোরআনের ১০ নম্বর সুরার নামকরণ তাঁর নামে। অন্যান্য নবীদের মতো তাঁরও সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল, জাতিকে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করা। কিন্তু তারা তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি। এতে নিরাশ হয়ে তিনি নিজ এলাকা নিনেভা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে উদ্যত হন। ইউনুস (আ.) নিনেভায় প্রেরিত হয়েছিলেন। এটি তৎকালীন ইরাকের মসুলে অবস্থিত।

নিনেভা ছেড়ে চলে যাওয়ার পথে আল্লাহ তাআলা তাকে পরীক্ষা করেন।সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জন্য তিনি একটি জাহাজে ওঠেন। জাহাজটি মাঝসমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। তখন জাহাজের চালক ধারণা করে যে, জাহাজে কোনো অপরাধী আছে, যে বিপদ ডেকে এনেছে। পরে সেকালের নিয়ম অনুযায়ী লটারির ব্যবস্থা করা হয়। লটারিতে বারবার ইউনুস (আ.)-এর নাম ওঠে।

তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হলে জাহাজটি বিপদ থেকে রক্ষা পায়, আর একটি বিরাট মাছ ইউনুস (আ.)-কে গিলে ফেলে। (ফাতহুল বারি, খণ্ড: ১০, পৃষ্ঠা-২১২)এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ইউনুসও রাসুলদের একজন ছিল। স্মরণ করো, যখন সে পালিয়ে বোঝাই নৌযানে পৌঁছল, অতঃপর সে লটারিতে যোগদান করে পরাভূত হলো। পরে একটি মাছ তাকে গিলে ফেলে, তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল।

সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত, তাহলে তাকে কেয়ামত পর্যন্ত ওই উদরে থাকতে হত।’ (সুরা সাফফাত: ১৩৯-১৪৪)তখন ইউনুস (আ.) কঠিন বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য আল্লাহর কাছে একটি দোয়া করেছিলেন। যেটি দোয়া ইউনুস নামে পরিচিত। দোয়াটি হলো—আরবি: لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ উচ্চারণ: ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ-লিমিন।’ অর্থ: ‘তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান। আমি নিশ্চয়ই জালিমদের দলভুক্ত।’ (সুরা আম্বিয়া:৮৭)

ইউনুস (আ.) অক্ষত অবস্থায় সেই বৃহদাকার মাছের উদরে ৪০ দিন ছিলেন। সেখানে তিনি তাসবিহ-তাহলিল ও তওবা-ইস্তেগফার করেছিলেন এবং দোয়াটি পাঠ করেছিলেন। আল্লাহর অনুমতি আসার আগেই স্বদেশ ত্যাগ করার কারণে অনুশোচনাদগ্ধ হয়ে কান্নাকাটি করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা সেই কাহিনি বর্ণনা করে বলেন, ‘মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন; তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন। অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাকে পাকড়াও করবো না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেন- তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান। আমি নিশ্চয়ই জালিমদের দলভুক্ত। (সুরা আম্বিয়া:৮৭)

তবে, আল্লাহর নবী ইউনুস (আ.) মাছের উদরে অন্ধকারে ভীষণ কষ্টের মধ্যে থেকে আল্লাহপ্রেমের ও আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তখন আমি তার (ইউনুসের) ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদের নাজাত দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া: ৮৮) ৪০ দিন পর আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছিলেন। আল্লাহর হুকুমে মাছটি তাকে সমুদ্রের কিনারে উগরে দেয়। দীর্ঘদিন মাছের পেটে পানি-খাদ্যবিহীন থাকায় ইউনুস (আ.) ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল।

এই অবস্থা থেকে নিরাময়ের জন্য আল্লাহ তাআলা পরিবেশ দূষণমুক্তকারী এবং নির্মল ছায়াদানকারী লাউগাছ সেখানে গজিয়ে দেন। সেই লাউগাছটি এত দ্রুত গজিয়ে ওঠে যে, মুহূর্তের মধ্যে ঘন লতাপাতায় তা তাবুর আকার ধারণ করে। তিনি কচি লাউ খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন। কোরআনে কারিমে সেই ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে- ‘অতঃপর আমি ইউনুসকে এক বিস্তীর্ণ-বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করালাম এবং তখন সে রুগ্ন ছিল। আর আমি তার ওপর লতাবিশিষ্ট একটি লাউগাছ উদ্গত করলাম এবং তাকে লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করলাম। অতঃপর তারা ঈমান এনেছিল, অতঃপর আমি তাদের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপভোগ করতে দিলাম।’ (সুরা সাফফাত: ১৪৫-১৪৮)

দোয়া ইউনুস পাঠের ফজিলত

দোয়া ইউনুসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। যদি কেউ দোয়া ইউনুস কয়েকবার পড়ে দোয়া করে তার দোয়া কবুল হয়। কেউ যদি বিপন্ন বা বিপদগ্রস্ত অবস্থায় এই দোয়া পাঠ করে, আল্লাহর রহমতে সে বিপদ থেকে উদ্ধার পায়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! এই দোয়ার গ্রহণযোগ্যতা কি কেবল ইউনুস (আ.)-এর জন্যই প্রযোজ্য, না সব মুসলিমের জন্য? জবাবে প্রিয়নবী (স.) বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে তার জন্য দোয়াটি বিশেষভাবে কবুল হলেও এটা সব মুসলিমের জন্য সবসময় কবুলের ব্যাপারে প্রযোজ্য। তুমি কি কোরআনে পাঠ করোনি, ‘ওয়া কাজালিকা নুনজিল মুমিনিন- আর এভাবেই আমি আল্লাহ মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি।’ (তিরমিজি: ৩৫০৫)

বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে, দৈনিক এক হাজার বার দোয়া ইউনুস পড়লে পদমর্যাদা সমুন্নত হয়। আল্লাহ তার রুজি-রোজগারে সমৃদ্ধি দান করেন। দুঃখ-যন্ত্রণা, পেরেশানি, অশান্তি ও কষ্ট-প্রভৃতি দূর করেন। তার জন্য সব রকম কল্যাণের দ্বার খুলে দেন। শয়তানের প্ররোচনা থেকে তাকে রক্ষা করেন।এ দোয়া এক লাখ পঁচিশ হাজার বার পড়ারও একটি নিয়ম রয়েছে। যেটা খতমে ইউনুস হিসেবে পরিচিত।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নবী-রাসুলদের জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। বিপদ-মসিবতে দোয়া ইউনুস পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার তাওফিক দান করুন। আমিন।