20 February 2024 , 4:38:23 প্রিন্ট সংস্করণ
২০২২ সালের ২২ আগষ্টে প্রসব ব্যথা নিয়ে কক্সবাজার শহরের একটু বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন হতদরিদ্র মাফিয়া বেগম (৩৮) নামে এক নারী। ওইদিনই সিজার করেন ক্লিনিকটির দায়ীত্বে থাকা স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ (গাইনি) বিশেষজ্ঞ ডা: খাইরুন্নেছা মুন্নি। অপারেশন শেষে পেটের মধ্যে একটি কাঁচি রেখেই সেলাই করে দেন চিকিৎসক। ভুক্তভোগী মাফিয়া কক্সবাজার শহরের পেসকার পাড়া এলাকার মোঃ ইউসুফের স্ত্রী। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায় হলেও দীর্ঘবছর ধরে পেশকার পাড়ার একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তারা।তাদের অভিযোগ, ভুক্তভোগী ওই নারী প্রায় ১৩ মাস ধরেই শরীরে নানা ধরনের রোগ বালাই নিয়ে বিভিন্ন সময় ডাক্তার, কবিরাজসহ নানা ধরনের চিকিৎসকের কাছে ধর্না দিয়েছেন। কিন্তু সুস্থ হতে পারেননি কখনো। ধীরে ধীরে যাচ্ছিলেন মৃত্যুর দিকে।
এসময় চিকিৎসা চালাতে গিয়ে স্বামীর ব্যবসা প্রতিষ্টান, স্থাবর-অস্থাবর সহায় সম্পত্তি সব ঘুচিয়ে অভাব অনটনের সঙ্গে দিনাতিপাত করছেন। এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা দেওয়ার কথা দিয়েও কথা রাখেনি ডাক্তার। উল্টো সেই টাকা চাইতে গিয়ে ওই নারী চিকিৎসকের হুমকি-ধামকিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবারটি।অসুস্থ মাফিয়া বেগম জানান, অপারেশনের পর থেকে পেটে ব্যথা শুরু হলে তিনি মুন্নির চেম্বারে যান। মুন্নি তাকে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে প্রায় ১৩ মাস চেপে রাখেন পেটব্যথা। কিন্তু কোনো পরিবর্তন না দেখে মাফিয়া কখনো ঢাকা, কখনো চট্টগ্রাম কখনো গ্রাম্য ডাক্তার এমনকি যখন যে যা বলেছে সেখানেই ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন একটু ভালো থাকার আশায়। গেল বছরের আগষ্টে তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে যান। সেখানে ওইদিন বারবার চেকআপ করার পর এক্সতে তার পেটের মধ্যে একটি ৯ ইঞ্চি কাঁচি ধরা পড়ে। এরপর তাকে আবারও দ্রুত অপারেশন করে কাঁচি বের করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
মাফিয়া বেগম আক্ষেপ করে জানান, ২০২২ সালের ২২ আগস্ট প্রচন্ড প্রসব বেদনা নিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে যান। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র যেতে পরামর্শ দেন। তখন তিনি তাৎক্ষণিক কোন উপায় দেখে ডাঃ খাইরুন্নেছা মুন্নীর শরণাপন্ন হন। ডাঃ জরুরীভাবে সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারী করে নবজাতকটিকে মৃত বলে ঘোষণা দেন। তিনদিন পর রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। হাসপাতাল থেকে যাওয়ার পর পেট ব্যাথা শুরু হলে পুনরায় খাইরুন্নেছা মুন্নীর কাছে যান। তখন তিনি মাফিয়াকে সিজারের পর একটু স্বাভাবিকভাবে ব্যাথা হয় বলে সান্তনা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। দিনের পর দিন ব্যাথার তীব্রতা বাড়তে শুরু করলে দিকবেদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন পরিবারটি। বারবার ছুটে যান ডাক্তার মুন্নির কাছে। প্রতিবারই একই কায়দায় বিভিন্ন পরীক্ষা করে রিপোর্টে কিছু না পেয়ে রোগীকে রেস্ট করতে বলেন ওই ডাক্তার।
এভাবে দিনের পর দিন ব্যাথার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও খুলনায় বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন মাফিয়া। প্রতিটি ডাক্তার পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে মাফিয়ার শরীর স্বাভাবিক রয়েছে দাবি করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সর্বশেষ ১ বছর ৫দিন পর ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখান তিনি। ডাক্তারকে এক্স-রে ও আলট্রাসোনোগ্রাফী করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। ডাক্তার তার অনুরোধে বিরক্ত হয়ে বলেন ডাক্তার আমি নাকি তুমি.? কি পরীক্ষা দিতে হবে না দিতে তা আমি বুঝব বলে তাড়িয়ে দেন। পরদিন আবার টিকেট কেটে অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে এক্স-রে করেন মাফিয়া। এক্স-রের রিপোর্ট দেখে টেকনিশিয়ান ও রোগীর পরিবারের স্বজনদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। রিপোর্টে দেখা যায় আস্ত একটা কাঁচি তার পেটের ভিতর।ভূক্তভোগী মাফিয়া বেগমের স্বামী মোঃ ইউসুফ জানান, হাসপাতালের ল্যাবের টেকনিশিয়ানের কাছ রিপোর্ট চাইলে তারা কোন ডাক্তারের কাছ থেকে সিজার করিয়েছি জানতে চান। পরে ডাঃ খাইরুন্নেছা মুন্নীর নাম বললে পরীক্ষার রিপোর্টটি গায়েব করে ডাক্তার খাইরুন্নেছা মুন্নীকে খবর দেন।
তিনি সাথে সাথে তার সাঙ্গ-পাঙ্গ পাঠিয়ে একটি সিএনজিতে করে তার চেম্বারে নিয়ে যান। এসময় ডাক্তার মুন্নি নানা ধরনের হুমকি দেন। পরে কাকুতি-মিনতি করে ওই দিন সন্ধ্যা ৬টায় অপারেশনের মাধ্যমে কাঁচি বের করে দিবে বলে শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দেন। তার এমন তাড়াহুড়া ভুক্তভোগী পরিবারটির মনে নানা সন্দেহ জন্ম দিলে পরে স্বজনদের সাথে আলোচনা করতে হবে জানিয়ে মুন্নির চেম্বার থেকে সটকে পড়েন। এমতাবস্থায় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে পেট থেকে কাঁচি বের করতে ডাক্তার মুন্নী দৌড়ঝাপ শুরু করেন। তার তত্ববধানে অপারেশন করতে অপারগতা প্রকাশ করলে তিনদিন পর মুন্নী সার্জারী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সেলিম উল্লাহ খাঁন নবাবের মাধ্যমে অপারেশন করে সেই কাঁচি বের করে নেন। এবং পেটের ভেতর কাঁচি রেখে সেলাই করার বিষয়টি গোপন রাখার জন্য রোগীর চিকিৎসা বাবদ ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিবে বলে আশ্বাস দেন।
মোঃ ইউসুফ আরও জানান, ডাঃ খাইরুন্নেছা মুন্নীর কথা মতে, ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিলেও বাকী টাকা তিনি দিচ্ছেন না। এদিকে রোগীর শারিরিক অবস্থা দিনদিন অবনতি হতে থাকেন। রোগী এখন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। ঠিকমত কাজ করতে পারে না। হাঁটাচলা করতে পারে না। শরীর দিনদিন অবস হয়ে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে ডাক্তারের কাছে টাকা চাইলে দিচ্ছে না। চিকিৎসার খরচ চালাতে নিজের কাপড়ের ব্যাবসা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে তার। বিষয়টি মিডিয়া ও বাইরে জানাজানি করে দিলে উল্টো প্রাণে মারাসহ বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন বলে অভিযোগ করেন ভূক্তভোগী পরিবারটি।উসুফ বলেন, তার কাপড়ের দোকান, শেষ সম্বল যা ছিলো সব বিক্রি করে সবটুকুই বিলিয়ে দিয়েছে স্ত্রীর চিকিৎসার পিছনে। ফুটপাতে হকারের ব্যাবসা করেও বর্তমানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পর্যন্ত ঠিক মতো জোটে না। খাইরুন্নেছা মুন্নীর ভয়ে আদালত বা প্রশাসনের কাছেও অভিযোগ দিতে যেতে পারছেন না।
এমতাঅবস্থায় একদিকে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে; অন্যদিকে ডাক্তার মুন্নির অব্যাহত হুমকিতে স্ত্রীকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।ভুক্তভোগী মাফিয়া বেগমের ফুফি হাসিনা আক্তার বলেন, সিজার করার পর থেকে তার ভাতিজি ব্যথায় কাতর হয়ে দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় কাটিয়েছেন। ব্যথার যন্ত্রনায় প্রতিদিন মাফিয়ার চিৎকারে আল্লার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠার মতো অবস্থা। তার কান্ড দেখে প্রথমে প্রথমে আমরাও হাসাহাসি করতাম। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলতাম সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়ে যে অবস্থা শুরু করেছো; আর কাউকে দেখিনি তোমার মত এমন ছেলেমানুষি করতে। পরে জানতে বাকী থাকেনা তার শরীরে কিছু একটা হয়েছে। পরে ওটাই সত্যি হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত ডাক্তার মুন্নির ঘনিষ্ঠ হিসেবে জনশ্রুতি থাকা সার্জারী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সেলিম উল্লাহ খাঁন নবাবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অপারেশনের মাধ্যমে পেট থেকে কাঁচি বের করার বিষয়টি স্মরণ নেই বলে অস্বীকার করেন।অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডাঃ খাইরুন্নেছা মুন্নীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।কক্সবাজারের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ নোবেল কুমার বড়ুয়া বলেন, কোন ভূক্তভোগীর অভিযোগ এখনো পায়নি। যদি এরকম হয়ে থাকে তদন্ত করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আইনগত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।