আন্তর্জাতিক

অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রক্তাক্ত আরেক বছর

অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রক্তাক্ত আরেক বছর

ইউক্রেইন যু্দ্ধ ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নিয়ে শুরু হওয়া ২০২৩ সাল শেষ হচ্ছে গাজা যুদ্ধ ম্যধপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে। মাঝে পুরো বছরজুড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঝরেছে রক্ত, নিভেছে প্রাণ। প্রতিবারের মতো এবছরও কিছু সন্ত্রাসী হামলা, দুর্ঘটনা, দুর্যোগ-দুর্বিপাক কেড়ে নিয়েছে আরও মানুষের প্রাণ। তার ওপর এল নিনোর প্রভাবে ইতিহাসের উষ্ণতম বছর কিংবা বিশ্বজুড়ে ফসল উৎপাদনে ঘাটতি মানবিক সংকট শুধু বাড়িয়েছে। কিছু বিশিষ্ট মানুষ নিয়েছেন চিরবিদায়।

তবে এসবের মাঝেও ঘটেছে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা।করোনাভাইরাস মহামারীর পর ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্বকে যে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছিল সেখান থেকে ফেরার কোনও রাস্তা দেখাতে পারেনি ২০২৩; বরং বিশ্বব্যাপী নতুন করে লড়াই-সংঘাত, গৃহযুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সংকটসহ বড় বড় সব দুযোর্গ-দুর্বিপাকে মানবিক সংকট আরও গভীর হয়েছে।

ইউক্রেইনে গতছর শুরু হওয়া রাশিয়ার আগ্রাসন এবছর জুড়েও চলেছে। তার মধ্যেই বছরের শেষ দিকে এসে বিশ্ববাসীর মনোযোগ কেড়েছে ইসরায়েল ও হামাসের লড়াই-সংঘাত। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলি বাহিনী এবং ইহুদি বসতিস্থপনকারীদের হামলা, আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হানাসহ আরও একাধিক কারণে ফিলিস্তিনিদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখন্ডে ঢুকে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস।

সেই হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো হামাসের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে গাজায় নির্মম হামলা শুরু করে। বিমান হামলার সঙ্গে শুরু হয় স্থল হামলাও। হামাস-পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, আড়াই মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় ২০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকায় সেখানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

গাজার ৬০ শতাংশ আবাসিক ইউনিটই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৮০ শতাংশের বেশি বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের কাছে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো না গেলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছে ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন সংস্থা। গাজার ফিলিস্তিনিরা ‘বিভীষিকাময়’ পরিস্থিতিতে পড়েছেন। রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে।

গাজা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে প্রতি মিনিটেই। সেখানকার মানবিক সংকট ছাপিয়ে গেছে ইউক্রেইন সংকটকেও।ইউক্রেইনের যুদ্ধে এবছর মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের হিসাবে, নিহত বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। এ যুদ্ধ বিশ্বে কেবল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই ডেকে আনেনি, মানবিক সংকটও সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে বিশেষ করে এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোতে রাশিয়া ও ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে অনেক বেশি।

ইউক্রেইন যুদ্ধের ধকলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে বাজার হয়েছে অস্থির। সরবরাহ-চেইনে সংকট বাড়িয়েছে নিত্যপণ্যের ঘাটতি। এসবের সঙ্গে ডলারের সংকট অনেক দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। নাগরিকদের খাবার, ওষুধ, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বহু দেশকেই পড়তে হয়েছে নতুন জটিলতায়।

গৃহযুদ্ধ : বিদায়ী এ বছরে বিশ্বজুড়ে আরো কয়েকটি দেশে গৃহযুদ্ধ, লড়াই-সংঘাতের তীব্রতা বেড়ে মানবিক সংকট গভীর হয়েছে। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধে লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ বছরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে মিয়ানমার জান্তা সরকার।

চীন সীমান্তবর্তী শান রাজ্য এবং পশ্চিম রাখাইন রাজ্যের সেনা ফাঁড়িগুলোতে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোটের একের পর এক সমন্বিত হামলার মুখে পড়ে কোণঠাসা হচ্ছে সামরিক বাহিনী।

জাতিসংঘের হিসাবমতে, গত অক্টোবরের শেষ দিকে মিয়ানমারে তীব্র লড়াই শুরুর পর ৩ লাখের বেশি মানুষ পালিয়ে গেছে। আর সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২০ লাখের বেশি মানুষ। চীন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতা করলেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোট হামলা চালিয়ে যেতেই বদ্ধপরিকর রয়েছে।

ওদিকে, ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের কোনও সুরাহা এবছরও হয়নি; বরং নৌকায় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গাদের ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার ঘটনা আরও বেড়েছে। এবছর রেহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢেউ বেশি দেখা গেছে ইন্দোনেশিয়ায়। গত নভেম্বর মাস থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া উপকূলে পৌঁছেছে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার ১,২০০ রোহিঙ্গা।

উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে তা চলছে। সুদানের সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান এবং সহযোগী বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) কমান্ডার মোহামেদ হামদান দাগালোর মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে ১৫ এপ্রিল থেকে এ লড়াইয়ের সূত্রপাত। সহিংসতা আরো নতুন নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে মানবিক বিপর্যয় আরও তীব্র হচ্ছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সুদানে সাত মাস ধরে চলা সংঘাতে অন্তত ৯ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। অন্তত ৭০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুও হয়েছে। মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় এবং ভয়াবহ মানবাধিকার সংকটের মুখোমুখি হয়েছে দেশটি।

সামরিক অভ্যুত্থান-রাজনৈতিক সংকট : আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে এ বছর সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারে সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমকে বন্দি করে একদল সেনা সদস্য। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক কর্নেল অভ্যুত্থানের ঘোষণা দিয়ে বলেন, তারা নাইজারের সংবিধান বিলুপ্ত ঘোষণা করছেন। সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাতিল এবং দেশের সব সীমান্ত বন্ধের ঘোষণাও দেন তিনি।

নাইজারের জান্তা ক্ষমতা ছাড়তে অপরাগতা প্রকাশ করায়, দেশটিতে ১৫ দেশের জোট ইকোয়াসের সম্মিলিত সামরিক হামলার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেনাবাহিনীর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে নাইজারে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে নাইজেরিয়া। ইকোয়াস কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সংকটে পড়ে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে নাইজারের মানুষ।

আফ্রিকার আরেক দেশ গ্যাবনেও এবছর সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট আলি বঙ্গো ওন্ডিম্বা ক্ষমতাচ্যুত হন। এর মাধ্যমে গ্যাবনে বঙ্গো পরিবারের টানা ৫৬ বছরের শাসনের অবসান হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিসহ আরও নানা বিষয় নিয়ে দেশটিকে ঘিরে জনগণের অসন্তোষ ছিল। বঙ্গো পরিবারের প্রতিও গ্যাবনের বাসিন্দাদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে তীব্র অসন্তোষ জন্ম নিয়েছিল।

আফ্রিকা মহাদেশের আরও কয়েকটি দেশ এবছর সশস্ত্র সংঘাত ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, কংগ্রেস, সুপ্রিম কোর্টে বোলসোনারো সমর্থকরা তাণ্ডব চালিয়েছে। মার্কিন ক্যাপিটল ভবনে ডনাল্ড ট্রাম্পের অনুসারীদের নজিরবিহীন নৈরাজ্যের পুনর্মঞ্চায়ন ঘটে ব্রাজিলে।

দেশটির অতি- ডান সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর কট্টর সমর্থকরা তাণ্ডব চালায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, কংগ্রেস আর সুপ্রিম কোর্টের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। ২০২২ এর ৩০ অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থি লুলা ডি সিলভার জয়ের পর থেকেই দু’মাস ধরে টানটান উত্তেজনা চলছিল ব্রাজিলে; তারই বিস্ফোরণ ঘটে এদিন।

পরাজিত প্রার্থী জাইর বোলসোনারোর হাজার হাজার সমর্থক রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় লঙ্কাকাণ্ড ঘটায়। জাতীয় পতাকার রঙে হলুদ-সবুজ পোশাক পরিহিত বিক্ষোভকারীরা বানের পানির মত সুপ্রিম কোর্ট ও কংগ্রেস ভবনে প্রবেশ করে, স্লোগান দেয়, আসবাবপত্র ভাঙে। অন্তত তিন হাজার মানুষ এই বিশৃঙ্খলায় অংশ নেয়। নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ে জালিয়াতির অভিযোগ করেছিলেন বোলসোনারো। সেই অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও তা তার সমর্থকদের সহিংস বিক্ষোভের ইন্ধন জুগিয়েছে।

আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘাত : আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধের উৎস হয়ে থাকা নাগোরনো-কারাবাখের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবছর নিয়ে নিয়েছে আজারবাইজান। এতে প্রায় ৩০ বছর ধরে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা জাতিগত আর্মেনীয় বাসিন্দাদের অধিকাংশ নিরাপত্তা শঙ্কায় প্রতিবেশী আর্মেনিয়ায় পালিয়ে গেছে। এই গণবাস্তুচ্যুতি পুরো অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় করে তোলার শঙ্কা বাড়ায়।

আর্মেনিয়া ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ আজারবাইজান বন্ধ করে রাখায় খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র ঘাটতি দেখা দেওয়ার অভিযোগ জাতিসংঘে তোলেন আর্মেনিয়ার বিশেষ প্রতিনিধি। নাগার্নো-কারাবাখে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রতিনিয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে বাকু বাধা দেওয়ায় সেখানকার সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপও কামনা করে আর্মেনিয়া।

বন্যা-ঘূর্ণিঝড় : লড়াই-সংঘাতের বাইরে এবছর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ আরও তীব্র ও প্রাণঘাতী হয়ে মানবিক সংকট গভীর করেছে। নতুন নতুন এলাকা অপ্রত্যাশিত বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে। এতে বহু মানুষের মৃত্যু ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঝড়ে মালাউয়ি ও মোজাম্বিকে ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায়।

ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের পর চলতি শতাব্দীর সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলে শুধু লিবিয়ায় অন্তত ১১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ভারি বৃষ্টিপাতের চাপে দুটি বাঁধ ভেঙে যায়। এতে নেমে আসা পানির প্রবল তোড়ে দেশটির উপকূলীয় শহর দেরনার এক চতুথাংশ ধ্বংস হয়ে যায়।মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি ও অ্যালাবামায় বেশ কয়েকটি টর্নেডোর তাণ্ডবে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়।

এর মধ্যে একটি টর্নেডোর আঘাতে মিসিসিপির রোলিং ফোক ও সিলভার সিটি শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।মিয়ানমারে ঘূর্ণিঝড় মোখায় রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তুয়ের ৯০ শতাংশেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৃত্যু হয় রাখাইনে আগে থেকেই শোচনীয় অবস্থায় থাকা বাসিন্দারা মোখার আঘাতে আরও চরম মানবিক সংকটে পড়ে।

ফেব্রুয়ারিতে ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ফ্রেডির তাণ্ডবে আফ্রিকার দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। মে মাসে আফ্রিকার দেশ কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের পূর্বাঞ্চলীয় গ্রামগুলোতে ধারাবাহিক বন্যা ও ভূমিধসে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

তবে বছরশেষে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত এবারের কপ২৮ জলবায়ু সম্মেলনে কিছু আশার আলো দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথমবারের মতো একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। তারা সর্বসম্মতভাবে চুক্তি সই করে। জলবায়ু সম্মেলনের ৩০ বছরের ইতিহাসে এটি এ ধরনের প্রথম চুক্তি।

ভূমিকম্প : বিশ্বে ঘন ঘন ভূমিকম্পের সাক্ষী হয়েছে ২০২৩। এসব ভূমিকম্পে বহু মানুষের মৃত্যু হওয়াসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি মানবিক বিপর্যয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সারা বিশ্বে ঘটা কয়েকটি মারাত্মক ভূমিকম্পের মধ্যে আছে- মরোক্কোয় গত ৮ সেপ্টেম্বরের ভূমিকম্প। দেশটির ভূমিকম্পের ইতিহাসে গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম ছিল এটি। তিন হাজার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে।

এছাড়া, ২১ শতকের পঞ্চম প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আফগানিস্তানে গত ৭ অক্টোবরের ভূমিকম্পে এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।

নভেম্বরে গত আট বছরের মধ্যে হওয়া সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পে নেপালে মৃতের সংখ্যা ১৫৭ ছাড়িয়ে যায়। ডিসেম্বরে চীনে ভূমিকম্পে ১৩১ জন নিহত হয়। ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গানসু প্রদেশে ৫ হাজারের বেশি বাড়িঘর ধসে পড়ে। ২০১৪ সালের পর থেকে চীনে এবারের ভূমিকম্পটিই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী।

শতাব্দীর প্রাণঘাতী দাবানল : এক শতাব্দীর বেশি সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে প্রাণঘাতী দাবানলে হাওয়াই রাজ্যের মাউই দ্বীপে ১০৬ জনের মৃত্যু হয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় মাউই দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী শহর লাহাইনা।

শতাধিক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এ দাবানলে ২২০০টিরও বেশি ভবন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এগুলোর ৮৬ শতাংশই আবাসিক ছিল। মোট ক্ষতির পরিমাণ ৫৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

কানাডাতেও আরেক ভয়াবহ দাবানলে এবছর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মুখ্যমন্ত্রী ডেভিড ইবি বলেন, “আমাদের প্রদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানল মোকাবেলা করছি আমরা।” জলবায়ু পরিবর্তন কানাডার এই দাবানল পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যায়।

আর্থিক বিপর্যয়ে বিশ্ব মন্দার শঙ্কা : যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে এবছর আর্থিক খাতও বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহত্তম ব্যাংক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক দেউলিয়া হয়। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই চূড়া থেকে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন আর্থিক ও প্রযুক্তি খাতে চরম বিস্ময়ের জন্ম দেয়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার বৃহত্তম ঘটনা। এতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আর্থিক ব্যবস্থার বিপর্যয় থেকে আরেকটি বিশ্ব মন্দার শঙ্কা দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বাজারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারেও দেখা দেয় আন্দোলন।যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহৎ বিপর্যয়ের মধ্যে আরও একটি ব্যাংকের পতন ঘটে।সান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক ফার্স্ট ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে দুই মাসে এ নিয়ে তৃতীয় ব্যাংকের পতন হয়।

আর এতে ব্যাংক খাতের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে। নতুন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন; যে নির্বাচন প্রতিবারই থাকে বিশ্ববাসীর মনোযোগের কেন্দ্রে। তাই এবার বছর শেষের সময় থেকেই ২০২৪ সালের এই নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। আর তাতে আবার আলোচনায় উঠে এসেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।

ফের দৃশ্যপটে ট্রাম্প : যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাসী দেশটির অভ্যন্তরীন ও পররাষ্ট্রনীতির আরেক দফা গতি পরিবর্তনের আশঙ্কায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প ফিরে আসতে পারেন এবং আরেক দফায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এবং বিশ্বরাজনীতিতে দেশটির ভূমিকা হুমকিতে পড়তে পারে বলে এর মিত্রদেশগুলোর মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট, যাকে ফৌজদারি মামলায় বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সাবেক পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে সম্পর্কের ঘটনা ধামাচাপা দিতে গোপনে অর্থ দেওয়ার মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ট্রাম্প। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার জন্য রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার দৌড়ে থাকার সময়েই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়েছে।

কিন্তু আইনি ঝামেলা দিন দিন বাড়তে থাকলেও ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য রিপাবলিকান প্রার্থীদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমেনি। অন্য সব মনোনয়নপ্রত্যাশীদের চেয়ে তিনি অনেক এগিয়ে। বরং ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর যেন তার অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। সম্প্রতি কিছু জনমত জরিপে তাকে বতর্মান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়েও এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। আবার কোনও জরিপে বাইডেনের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হাড্ডাহাড্ডি হওয়ারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

তবে বছরের শেষে ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার জেরে কলোরাডোর সর্বোচ্চ আদালত আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হিসেবে ডনাল্ড ট্রাম্পকে অযোগ্য ঘোষণা করায় তার কলোরাডোর  প্রাইমারি ভোটে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে। এতে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন শেষ হতে চলেছে কিনা তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।যদিও এই রায় শুধু মাত্র আগামী বছর ৫ মার্চ কলোরাডোতে অনুষ্ঠেয় রিপাবলিকান প্রাইমারির জন্য প্রযোজ্য। তবে এটা নিশ্চিত যে, তা ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলবে।

ট্রাম্প অবশ্য হাল ছাড়েননি। বরং এ রায়ের বিরুদ্ধে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। ফলে তার ভাগ্য এখন ঝুলে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের হাতে। সাবেক এ প্রেসিডেন্ট আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য কিনা সে সিদ্ধান্ত নেবেন সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতি। যাদের মধ্যে তিন জনের নিয়োগ দিয়েছেন খোদ ট্রাম্প। সেখানে ৬-৩ এ রক্ষণশীলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে রায় ট্রাম্পের পক্ষে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েও সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পুতিন : ট্রাম্পের ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার মতো এবছর আরেকটি যুগান্তকরী ঘটনা ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি)-র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।

ইউক্রেইনে যুদ্ধাপরাধ এবং শিশুদের ইউক্রেইন থেকে অবৈধভাবে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে পুতিনকে দায়ী করে আইসিসি-র একজন বিচারক এই পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। পরাশক্তির দেশগুলোর সরকার প্রধানদের মধ্যে কোনও নেতাকে গ্রেপ্তার করতে আদালতের এমন আদেশ ছিল এবারই প্রথম।

যদিও পুতিনের জন্য সুবিধা হল, নিজ দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তাকে আইসিসি-র কাছে ক্রেমলিনের হস্তান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই। যতদিন তিনি রাশিয়ায় থাকবেন, ততদিন গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি নেই। রাশিয়ার বাইরে গেলে পুতিন আটক হতে পারেন। কিন্তু ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় তার চলাফেরা সীমিত হয়ে গেছে। তাই যে দেশ তাকে বিচারের আওতায় আনতে চায়, সেখানে পুতিনকে পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

তাছাড়া, তাকে বিচারের ক্ষেত্রে অন্তত দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়া আইসিসি-র এখতিয়ার বা কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। আইসিসি গঠনের চুক্তিতে রাশিয়া সই না করায় সংস্থাটির পরোয়ানায় রাশিয়া থেকে কাউকে প্রত্যর্পণের বাধ্যবাধকতাও দেশটির নেই। দ্বিতীয়ত, বিবাদী ছাড়া কাঠগড়ায় বিচার পরিচালনার বিষয়টি সবার অজানা না হলেও, এটি এখানে খাটে না। আইসিসি কারও অনুপস্থিতে বিচার করে না, তাই সেই পথটিও বন্ধ।

ওদিকে, ইউক্রেইনে যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রেসিডেন্ট পুতিনের মাথায় চেপেছে আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, সেই যুদ্ধই চালিয়ে যাওয়ার জন্য বছর শেষে এসে তার পক্ষে পরিস্থিতি সুবিধাজনক করে দিয়েছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ; যা গোটা বিশ্বের নজর ঘুরিয়ে দিয়েছে পশ্চিম এশিয়ার দিকে।

ফিলিস্তিনের মানবিক সঙ্কটের প্রভাব যে পড়বে ইউক্রেইন যুদ্ধের ওপরে, বিশেষত পশ্চিমা সহায়তার ক্ষেত্রে, তা ভালই জানেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এ অবস্থায় চাপ বাড়বে ইউক্রেইনের উপরেই। যুদ্ধ যত দিন চলবে, তত দিন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি মিত্রশক্তিগুলোর পূর্ণ মদদ পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

রাশিয়ার রণকৌশল হচ্ছে, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যতক্ষণ না ইউক্রেইন সমর্থন হারায়। আর সহায়তা পাওয়ার দিক থেকে ইউক্রেইনের জন্য নতুন বছর যে খুব আশাব্যঞ্জক হবে না- তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইসরায়েল এবং ইউক্রেইনকে আরও সাহায্য দেওয়ার আবেদন কংগ্রেসের রিপাবলিকানরা নিজ দেশের সীমান্ত সুরক্ষার শর্তে এরই মধ্যে আটকে দিয়েছেন। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও একাধিক বছরের আর্থিক সাহায্যের সিদ্ধান্ত জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে হাঙ্গেরির বিরোধিতার কারণে।

কোভিডের সমাপ্তি ঘোষণা : কোভিড-১৯ আর ‘বিশ্ব জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা’ নয় বলে এবছরই মে মাসে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) । এ ঘোষণা বিশ্বে করোনাভাইরাস মহামারীর সমাপ্তি জানান দেওয়ার পথে ছিল বড় ধরনের এক পদক্ষেপ। ২০২০ সালে প্রথম কোভিডের জন্য ডব্লিউএইচও’-এর সর্বোচ্চ স্তরের সতর্কতা জারির তিন বছর পর তা তুলে নেওয়ার এই ঘোষণা আসে।

ডব্লিউএইচও জানায়, গত কয়েক বছরে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে কোভিডে। বিশ্ব অর্থনীতিকে তছনছ করেছে, বহু মানব গোষ্ঠীকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে কোভিড। এখন থেকে কোভিড বিশ্ব স্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থার অন্তর্ভুক্ত আর নয়। যদিও এই জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া মানেই ঝুঁকি কমে যাওয়া বা আশঙ্কা কমে যাওয়া নয় বলেও সতর্ক করেন তিনি।

বছরের শেষের দিকে এসে কোভিডের ওমিক্রন ধরনের নতুন এক উপধরন জেএন.১ এর প্রকোপ দেখা গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। জেএন.১ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি)। এছাড়া চীনে ৭ জন এই উপধরনে সংক্রমিত হয়েছে। ভারতের কেরালা রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে জেএন.১ সংক্রমণ এবং এতে মানুষের মৃত্যু হওয়ার খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, আপাতত এই উপধরনটি জনস্বাস্থ্যের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ বলেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোভিড প্রতিরোধে বর্তমানে যেসব টিকা চালু আছে সেটি দিয়েই এই উপধরনের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা মিলবে। ভারতের চাঁদ জয়, সংসদে বিরোধী এমপি বরখাস্তের হিড়িক : চাঁদের রহস্যে ঘেরা দক্ষিণ মেরুতে প্রথম কোনও দেশ হিসেবে অগাস্টে পা রাখে ভারত। ২৩ অগাস্ট চাঁদের মাটি স্পর্শ করে ইতিহাস গড়ে চন্দ্রযান-৩। বিশ্বের আর কোনও দেশ সেখানে এখন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। ভারতের কোটি কোটি মানুষের চোখ ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠের সেই দক্ষিণ মেরুতে।

এই অভিযানে সফল হওয়ায় বিশ্বে চাঁদে পা রাখা চতুর্থ দেশ হয় ভারত। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন চাঁদে নামতে সফল হয়েছিল। ভারতের মহাকাশযান চাঁদে অবতরণের কয়েকদিন আগে ২০ অগাস্টে চাঁদের পৃষ্ঠে ধাক্কা খেয়ে রাশিয়ার মহাকাশযান লুনা-২৫ বিধ্বস্ত হয়।রাশিয়ার মহাকাশযানেরও নামার কথা ছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই। কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছানোর একদিন আগেই বিধ্বস্ত হয় সেটি। এরপরই রাশিয়াকে টেক্কা দিয়ে চাঁদের মাটিতে সফল পদচারণা করে চমক দেখায় ভারত।

ডিসেম্বরে ভারতে তিনদফায় ১৪১ জন বিরোধী এমপি বরখাস্তের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশনে ভারতে একসঙ্গে এতজন সাংসদকে বরখাস্ত করার ঘটনা দেখা যায়নি।ভারতের লোকসভায় দুই আগন্তুকের অনুপ্রবেশে নিরাপত্তা ভঙ্গের ঘটনা নিয়ে হট্টগোল করার জেরে পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন- দুই কক্ষ থেকে এই এমপি’রা বরখাস্ত হন। এতে পার্লামেন্ট প্রায় বিরোধীশূন্য হয়ে যায়। গণহারে এমন বরখাস্তের ঘটনায় চটে যান বিরোধীরা। সরকার সংসদকে এভাবে বিরোধীমুক্ত করতে চাইছে- যাতে বিতর্কিত সব বিল বিনা বাধায় কিংবা বিনা আলোচনায় পাস করানো যায় বলে অভিযোগ তোলেন তারা।

ইমরান খানের জেল, রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা : পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের চেয়ারম্যান ইমরান খানকে তোষাখানা মামলায় ৫ অগাস্ট তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় ইসলামাবাদের একটি আদালত। এ রায়ের কিছুক্ষণের মধ্যেই লাহোর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। এরপর পাকিস্তানের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ ইমরান খানকে ৫ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তোষাখানা দুর্নীতি মামলায় ইমরানকে দোষী সাব্যস্ত করে ইসলামাবাদ আদালত তাকে ৩ বছরের জেল দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশন এ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে ।

চীনের প্রেসিডেন্ট পদে শি’র ঐতিহাসিক তৃতীয় মেয়াদ : নজির ভেঙে এবছর টানা তৃতীয় মেয়াদের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন শি জিনপিং। ১০ মার্চ চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শি সর্বসম্মতভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৃতীয়বারের মতো পুনর্নির্বাচিত হন। পদটি অনেকটা আনুষ্ঠানিক হলেও ইতোমধ্যেই মাও জেদংয়ের পর চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সাধারণ সম্পাদক শি ২০১৩ সাল থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন আছেন। ফের পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ায় ২০২৮ সাল পর্যন্ত তার ক্ষমতায় থাকার পট প্রস্তুত হল।

চীনকে টপকে ভারত সবচেয়ে জনবহুল দেশ : এবছরের মাঝামাঝি সময়ে (এপ্রিল-মে) চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। জাতিসংঘ প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ৮৬ লাখ। বিপরীতে চীনের জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ৫৭ লাখ। ১৯৫০ সাল থেকে জাতিসংঘ সবচেয়ে জনবহুল দেশের তালিকা তৈরি করে আসেছে। সে তালিকায় এবারই প্রথম শীর্ষে উঠে এসেছে ভারত। আর ৩৪ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

চীনে গত বছরই জনসংখ্যার নিম্নমুখী হতে দেখা গিয়েছিল। এর আগের বছর ২০২১ সালে দেশটিতে তুলনামূলক জন্মহার কম ছিল। আকাশচুম্বি খরচও অনেক চীনা পরিবারকে এক সন্তানের বেশি না নিতে বাধ্য করেছে, এমনকী এ কারণে অনেকে কোনো সন্তানই নিচ্ছেন না। চীনের স্থানীয় সরকারগুলো ২০২১ সাল থেকেই একের অধিক সন্তান নিতে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে; এগুলোর মধ্যে কর ছাড়, মাতৃত্বকালীন ছুটি দীর্ঘয়িত করা এবং ভর্তুকি মূল্যে বাড়ি দেওয়া অন্যতম। তারপরও দীর্ঘদিনের সেই ধারা এত তাড়াতাড়িই পরিবর্তিত হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে উত্তেজনা বছরশেষে প্রশমন : বছরের শুরুর দিকে আকাশে চীনা গোয়েন্দা বেলুন নিয়ে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সৃষ্ট উত্তেজনার পারদ বছর শেষে গলেছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি’র ওয়াশিংটন সফরের মধ্য দিয়ে। ৩ ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র জানয়েছিল, তারা কানাডা থেকে তাদের আকাশে ঢুকে পড়া একটি চীনা গোয়েন্দা বেলুন শনাক্ত করেছে। পরদিন জঙ্গি বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বেলুনটি ধ্বংস করে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এর ধ্বংসাবশেষ আটলান্টিক মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের জলসীমায় পড়ে। এর আগে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বেলুনটি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আকাশে অবস্থান করেছিল। বেলুনটিকে ধ্বংস করা নিয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষেট্রর বাদানুবাদে দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়ে।

পরে ১৪ থেকে ১৭ নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফরে করলে সম্পর্কে উত্তেজনার পারদ কমার আশা জেগে ওঠে। সফরে শি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই দেশের বন্ধ হয়ে থাকা সামরিক যোগাযোগ ফের শুরু করাসহ বাড়তে থাকা জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে সহযোগিতার বিষয়েও একমত হন তারা।

উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হামলার হুমকি : উত্তর কোরিয়া এবছর একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার সখ্যের জবাব ‘আরও আক্রমণাত্মক পাল্টা পদক্ষেপের মাধ্যমে’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। শত্রুর উস্কানির জবাবে পারমাণবিক অস্ত্র হামলা চালানোরও হুমকি দিয়েছে দেশটি। উত্তর কোরিয়া ডিসেম্বরে পঞ্চমবারের মতো আইসিবিএম ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায়। এর আগে বছরের শুরুর দিকে মার্চে একাধিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে তারা। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের যৌথ সামরিক মহড়া চলার মধ্যে পিয়ংইয়ং ওই পরীক্ষা চালায়।

এরপর এপ্রিলে নতুন একটি আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘হওয়াসং-১৮’ পরীক্ষা চালায় দেশটি; যেটি এটি এখন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রভান্ডারের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ক্ষেপণাস্ত্র। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের যৌথ সামরিক মহড়া ‘ফ্রিডম শিল্ড ২৩’ এর বিরোধিতায় এ মহড়ার আগে ও পরে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে শক্তি প্রদর্শন করে উত্তর কোরিয়া। ফের ডিসেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার পরই উত্তর কোরিয়া তাদের অত্যাধুনিক দীর্ঘ পাল্লার আইসিবিএম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়।

এ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উত্তর আমেরিকা মহাদেশে আঘাত হানতে সক্ষম।এই অস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর পরই শত্রুদের নতুন করে হুঁশিয়ার করে দিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন বলেন, কোনও শত্রু পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে উস্কানি দিলে পিয়ংইয়ং এর জবাবে পারমাণবিক হামলা চালাতে দ্বিধা করবে না।

চার্লসের রাজ্যাভিষেক : সাত দশকের মধ্যে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এবছর মাথায় রাজমুকুট পরেছেন চার্লস। গত ৬ মে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য কমনওয়েলথ ভুক্ত রাজ্যগুলোর রাজা হিসেবে তৃতীয় চার্লস ও রানি হিসেবে ক্যামেলিয়ার রাজ্যাভিষেক হয়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা যাওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হন বড় ছেলে চার্লস। এর আগে ৭০ বছর ধরে তিনি ব্রিটেনের রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন।

অবশেষে রাজ্যাভিষেকের সময় ৩৬০ বছরের পুরনো সেইন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট মাথায় পরানো এবং চতুর্দশ শতাব্দীর রাজসিংহাসনে বসার মাধ্যমে ব্রিটেনের প্রবীণতম রাজা হন চার্লস।রাজ্যাভিষেকের আয়োজন নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছিলেন, “অন্য কোনো দেশ এমন জমকালো প্রদর্শনী করতে পারেনি- রাজ শোভাযাত্রা, সমারোহ, আনুষ্ঠানিকতা ও স্ট্রিট পার্টি।

এটি আমাদের ইতিহাসের, সংস্কৃতির এবং ঐতিহ্যের এক গর্বিত প্রকাশ। আমাদের দেশের আধুনিক চরিত্রের এক প্রাণবন্ত প্রদর্শনী; একটি লালিত আচার-অনুষ্ঠান যার মাধ্যমে একটি নতুন যুগের জন্ম হয়। চার্লস ব্রিটেনের ৪০তম রাজা। সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজা চার্লস তার মা প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মত ব্যাপক প্রশংসিত না হলেও এখন পর্যন্ত তার প্রতি জনসমর্থন ইতিবাচকই বলা যায়।

হ্যারির স্মৃতিকথা : ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স হ্যারির বহুল আলোচিত স্মৃতিকথা ‘স্পেয়ার’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে আসে। এ বইয়ে রাজপরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা প্রকাশ করে বহু বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন হ্যারি। তাকে বইটি লিখতে ‘সাহায্য করেছিলেন’ মার্কিন ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক জেআর মোররিঙ্গার। অর্থাৎ, তিনি ‘স্পেয়ার’ এর গোস্ট রাইটার।

বইটিতে দাবি করা হয়েছে, হ্যারি তার বাবাকে (রাজা তৃতীয় চার্লস) দ্বিতীয় বিয়ে না করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, আফগানিস্তানে ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করার সময় হ্যারি ২৫ জন তালেবান যোদ্ধাকে হত্যা করেন, প্যানিক অ্যাটাক এড়াতে অবৈধ মাদক গ্রহণ করেন এবং তার স্ত্রী মেগানের সঙ্গে বড় ভাইয়ের স্ত্রী ক্যাথেরিনের বনিবনা ছিল না।প্রিন্স হ্যারি আরও জানিয়েছেন, তিনি তার নিজের পরিবারের কাছ থেকে নয় বিবিসি-র ওয়েবসাইট থেকেই প্রথম রানি এলিজাবেথের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন।

নেটো সদস্য ফিনল্যান্ড : গত ৪ এপ্রিল পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোর ৩১তম সদস্য রাষ্ট্র হয় ফিনল্যান্ড। এতে রাশিয়ার সঙ্গে নেটো জোটের সীমান্ত আগের তুলনায় দ্বিগুণ বড় হয়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করলে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়া ফিনল্যান্ড ওই বছর মে মাসেই নেটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে।

রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের এক হাজার ৩৪০ কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেইনে অভিযান চালানোর পর ফিনল্যান্ড তাদের ‘নিরপেক্ষতা’ নীতি বদলে পশ্চিমাদের সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নেয়। নেটোর অন্যতম নীতি হচ্ছে, সম্মিলিত প্রতিরক্ষা নীতি। এর অর্থ হচ্ছে, জোটের কোনও দেশের ওপর হামলা হলে তা জোটের সব দেশের ওপর হামলা বলেই বিবেচিত হবে।

ফিনল্যান্ডের নেটোভুক্তিকে অনেকেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য বড় কৌশলগত পরাজয় হিসাবে দেখছেন। নেটোতে থাকলে রুশ হামলার সম্ভাবনা কম, এ ধারণা থেকেই ফিনল্যান্ড এই জোটভুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অনুমান বিশ্লেষকদের।ইসরায়েল-ওমান, সৌদি-ইরান সম্পর্ক; আরব লিগে সিরিয়া : ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম ওমান তাদের আকাশপথ ইসরায়েলের এয়ারলাইন্সের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ইসরায়েলি এয়ারলাইনসকে নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিল সৌদি আরব। কিন্তু ওমানের আকাশসীমা বন্ধ থাকায় ইসরায়েলি উড়োজাহাজগুলো এশিয়ার আকাশে উড়তে সবচেয়ে সহজ রুটটি ব্যবহার করতে পারেনি।

অবশেষে এবছর ইসরায়েলের জন্য আকাশ উন্মুক্ত করেছে ওমান। তাছাড়া, অগাস্টে ইসরায়েল-সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির পরই বাহরাইন এবং ওমানও এ পথে হাঁটতে পারে বলে আভাস দেন ইসরায়েলের গোয়েন্দা বিষয়ক মন্ত্রী। ওদিকে, চীনের মধ্যস্থতায় এবছর মার্চে বেইজিংয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠকের পর ইরান ও সৌদি আরব নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধের অবসান ঘটিয়ে সম্পর্ক ফের শুরু করতে সম্মত হয়। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে শিয়া সম্প্রদায়ের এক বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে তেহরানে সৌদি আরবের দূতাবাসে উত্তেজিত ইরানি জনতার হামলার জেরে দুই পক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল।

অন্যদিকে, আরব লীগের নেতারা বছরের পর বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে এড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু এ বছর মে মাসে নীতি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শত্রুতার পাতা উল্টিয়ে আসাদকে ফের নিজেদের মাঝে ফিরিয়ে এনেছেন তারা। ২০১১ সালের প্রথমদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নির্মম দমনপীড়ন ও পরবর্তীতে সিরিয়ায় ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে আসাদ ও তার সরকারকে আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এক দশকেরও বেশি সময়ের বিচ্ছিন্নতার পর ফের আরব লিগে স্বাগত জানানো হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে।

বছরজুড়ে প্রযুক্তিবিশ্বে এআই : বছরজুড়েই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে প্রযুক্তিবিশ্বে। আরও বেশ কিছু প্রযুক্তি, পণ্য ও ব্যক্তি আলোচনায় ছিল বছরজুড়ে। এআইভিত্তিক নানা সুবিধাও চালু হয়।প্রযুক্তি খাতে জেনারেটিভ এইআই মডেলের ক্রমাগত উত্থান ঘটেছে। এই মডেলগুলো মেশিন পাঠ ও ভাষা প্রক্রিয়াকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। মডেলগুলো কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিত্রনাট্য তৈরির পাশাপাশি ছবি, সঙ্গীত তৈরির পারদর্শিতাও দেখিয়েছে।

১৪ মার্চ ওপেনএআই কোম্পানি জিপিটি-ফোর চালু করে। এটি চ্যাটজিপিটি-র একটি বড় ধরনের ভাষা মডেল। এটি ছবিতে সাড়া দিতে পারে এবং ২৫ হাজার শব্দ প্রক্রিয়া করতে পারে। তবে এআই নিয়ে সতর্কবার্তাও এসেছে। এই প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশে ঠিকমতো নজর না দিলে এটি আর্থিক ব্যবস্থায় নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে –এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে মার্কিন নিয়ন্ত্রকদের একটি প্যানেল। এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে যেসব ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে, তার মধ্যে সাইবার ও এআই মডেলের নিরাপত্তা ঝুঁকির মতো বিষয়গুলো আছে বলে উল্লেখ করে তারা।

বিশ্বজুড়ে নানা দুর্ঘটনা : প্রতিবছরের মতো এবছরও নানা দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বিশ্ব। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল টাইটান দুর্ঘটনা। গত ১৮ জুন পাঁচ আরোহী নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া ডুবোযান টাইটান ‘ভয়ঙ্কর অন্তর্মুখী বিস্ফোরণে’ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এতে পাঁচ আরোহীর সবার মৃত্যু হয়।

একশ বছরের বেশি সময় আগে সেই ১৯১২ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যাওয়া সেই সময়ের সর্ববৃহৎ জাহাজ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পর্যটকদের নিয়ে ডুব দিয়েছিল পর্যটন সংস্থা ওশানগেইটের ডুবোযান টাইটান। এর পৌনে দুই ঘণ্টার মাথায় টাইটানের সঙ্গে পানির ওপরে থাকা নিয়ন্ত্রক জাহাজ পোলার প্রিন্সের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর থেকে চলছিল টাইটানের উদ্ধার অভিযান। উদ্ধারকারীদের আশা ছিল, হয়ত কোনো কারণে টাইটান পানির নিচে তলিয়ে গেছে, ভেসে উঠতে পারছেন না।

যে কারণে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উদ্ধারকর্মীরা টাইটানের অবস্থান শনাক্ত করে সেটাকে তুলে আনতে চাইছিলেন। তাদের ভয় ছিল, ডুবোযানে সংরক্ষিত অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে সেখানে থাকা পাঁচ আরোহী দম বন্ধ হয়ে মারা পড়তে পারেন। উদ্ধার অভিযানের মধ্যেই খবর আসে, আটলান্টিকের তলদেশে উদ্ধার অভিযানে পাঠানো রোবটযানটি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে অন্য কিছুর ধ্বংসস্তূপ খুঁজে পেয়েছে, যেটি পরে টাইটানের বলে নিশ্চিত করে মার্কিন কোস্ট গার্ড।

অন্যান্য আরও দুর্ঘটনার মধ্যে আছে- ৩১ অগাস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের একটি ভবনে আগুন লেগে ৭৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা। পরিত্যক্ত এই ভবনটি নগরীর একটি অপরাধী দল দখল করে ফ্ল্যাটগুলো অবৈধ অভিবাসীদের কাছে ভাড়া দিয়েছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রিসের থেসালিতে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় ৫৭ জন নিহত হয়। এই দুর্ঘটনা গ্রিসের রেলওয়ের পরিস্থিতি ও এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে পুরো দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের কারণ হয়।

১৯ এপ্রিল ইয়েমেনের রাজধানী সানায় রমজান মাসে এক ত্রাণ অনুষ্ঠানে ভিড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে অন্তত ৯০ জন নিহত ও ৩২২ জন আহত হয়। ২ জুন ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের বাহানগা বাজার স্টেশনের কাছে দু’টি যাত্রীবাহী ও একটি মালগাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে অন্তত ২৯৬ জন নিহত হয়। আহত হয় ১২০০ জনেরও বেশি মানুষ। ১৩ জুন নাইজেরিয়ার কোয়ারা রাজ্যে নাইজার নদীতে বারযাত্রীবাহী একটি নৌকা ডুবে অন্তত ১০৬ জনের মৃত্যু হয়। ১৪ জুন গ্রিসের উপকূলে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহনকারী একটি নৌকা ডুবে অন্তত ৮২ জনের মৃত্যু হয়, নিখোঁজ হয় আরও ৫০০ জন।

অ গাস্টে রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গগামী একটি উড়োজাহাজ তিয়েভের অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়। সেই উড়োজাহাজের যাত্রী ছিলেন রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন, সহপ্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি ইউতকিনসহ আরও ৮ জন। উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে সবাই নিহত হন। যদিও এটি দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড তা নিয়ে সংশয় আছে।

কারণ, জুনে রাশিয়ায় ইয়েভগেনি প্রিগোজিন বিদ্রোহ করে বসার পরই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন একে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেছিলেন।সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে হওয়ার পর থেকে অনেকেই মনে করছিলেন, রুশ ভাড়াটে সেনা দল ওয়াগনারের প্রধান হয়ত নিজের নামে বিশেষ এক মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ফেলেছেন।

সন্ত্রাসী হামলা : বিশ্বব্যাপী জঙ্গি ও আত্মঘাতী হামলার তীব্রতা কমে এলেও পাকিস্তানে এবছর বেশ কয়েকটি বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৩০ জানুয়ারি- পাকিস্তানের পেশোয়ারে পুলিশ লাইনস এলাকার একটি মসজিদে বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ৮৭ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় আরও ১৫০ জন আহত হয়। হতাহতদের অধিকাংশই পুলিশ সদস্য।

১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের খাইবার পখতুনখাওয়া প্রদেশে দেরা ইসমাইল খান জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি চেকপোষ্টে জঙ্গি হামলায় সামরিক বাহিনীর ২৩ সেনা নিহত হয়। এ ঘটনায় গোলাগুলিতে ৬ জঙ্গিও নিহত হয়। বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্রে এবছরও ঘটেছে বেশি কিছু গুলির ঘটনা। ৭ জানুয়ারি- যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি এলিমেন্টারি স্কুলে ৬ বছর বয়সী এক বালকের গুলিতে এক নারী শিক্ষক গুরুতর আহত হয়। ছয় বছর বয়সী ওই বালক কীভাবে বন্দুক যোগাড় করল তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

২১ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় এক বাড়িতে গুলিতে ছয় মাসের একটি শিশু ও ১৭ বছর বয়সী এক মা’সহ ছয়জন নিহত হয়। একই মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে এক বলরুম ড্যান্স হলে গুলি করে ১০ জনকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া সন্দেহভাজন বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেন। সন্দেহভাজন ছিলেন এশীয় বংশোদ্ভূত এক বৃদ্ধ। আরেক ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার হাফ মুন বে শহরের দু’টি এলাকায় নির্বিচার গুলিতে সাতজন নিহত হয়।

ওদিকে, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোতে দুটি হামলার ঘটনায় সেনা ও বেসামরিকসহ অন্তত ২৮ জন নিহত হয়। বছরের শেষে এসে ডিসেম্বরে চেক প্রজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বন্দুক হামলা হয় রাজধানী প্রাহারের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টি ভবনে। এতে অন্তত ১৪ জন নিহত হয় এবং আহত হয় ২৫ জন। বন্দুকধারী ওই ফ্যাকাল্টিরই ছাত্র ছিল। হামলার পর সে আত্মহত্যা করে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

হেনরি কিসিঞ্জারের মৃত্যু : বিশ্ব এবছর হারিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ঊনিশশ সত্তরের দশকের স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম রূপকার হেনরি কিসিঞ্জারকে।২৯ নভেম্বর তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। জার্মান বংশোদ্ভূত এই সাবেক কূটনীতিক তার কানেটিকাটের বাড়িতে মারা গিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর কারণ জানানো হয়নি খবরে।যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের সময় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা কিসিঞ্জার মার্কিন কূটনীতিতে রেখে গেছেন অমোচনীয় ছাপ, পরবর্তী জীবনে ক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে।

চীন, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কূটনীতির সুরে এখনও কিসিঞ্জারের নীতি অনুরণিত হয়। বলা হয়, আনোয়ার সাদাত, মাও জে দং, রিচার্ড নিক্সন আর বাদশাহ ফয়সালের পররাষ্ট্রনীতিতেও তার প্রভাব ছিল। তুখোড় রাজনৈতিক মেধা আর কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য নিজের দেশে কিসিঞ্জার যতটা সমাদৃত, বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ-সংঘাতের ‘কারিগর’ হিসেবে ছিলেন ততটাই নিন্দিত। তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, বিশ্ব রাজনীতিতে তার প্রভাব সহসাই শেষ হবে না।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক নৃশংসতা দেখেও যে ভূমিকা কিসিঞ্জার নিয়েছিলেন, সেজন্য তিনি অনেকের ধিক্কারের পাত্র। ১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, যা এ পুরস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের একটি।  গত মে মাসে শতবর্ষ পূর্ণ করা কিসিঞ্জার শেষ দিনগুলোতেও ছিলেন দারুণ সক্রিয়। গত জুলাই মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আকস্মিক সফরে তিনি বেইজিংয়ে যান।

যিশুর জন্মভূমি বেথেলহেমে আনন্দবিহীন বড়দিন : যিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি বেথেলহেম সাধারণত খ্রিস্টীয় বড়দিনের সময় সবচেয়ে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু চলতি বছর যুদ্ধ ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি এ শহরটি থেকে পর্যটক ও পুণ্যার্থীদের দূরে ঠেলে দিয়েছে; ফলে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও স্যুভেনিরের দোকানগুলি ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে ছিল। ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজা ভূখণ্ডে নির্মম হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের, এর জেরে পশ্চিম তীরেও সহিংসতা বেড়েছে; এই পরিস্থিতিতে বেথেলহেমে কেউ যায়নি।

পুণ্যার্থী ও পর্যটকরা সাধারনত এখানকার নেটিভিটি গির্জা দেখতে আসেন, যিশু যেখানে জন্মেছিলেন গির্জাটি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে বলে বিশ্বাস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের। গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সবাই সেখানে হোটেলের বুকিং বাতিল করেছে। আসছে বছরের বুকিংও বাতিল হয়েছে। যেখানে বড়দিনের সময়ে ভিড় লেগেই থাকতো, লোকজন, হৈচৈ থাকত। এবার ছিল না তার কোনও কিছুই।

সাগরপথে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলায় উত্তেজনা : ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি গোষ্ঠীর হামলা চলার মধ্যেই আবার ভারত মহাসাগরে ট্যাংকারে হামলার ঘটনায় বছরের একেবারে শেষে এসে সাগরপথে উত্তেজনা বেড়েছে। বিশ্ব বাণিজ্যও হচ্ছে বিঘ্নিত। লোহিত সাগরে জাহাজে হামলার হুমকি বেড়ে যেতে থাকার কারণে বিশ্বের বড় বড় শিপিং কোম্পানি ওই রুটে তাদের জাহাজ চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।

এতে বিশ্ব বাজারে তেলসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির শঙ্কা বেড়েছে।গাজায় ইসরায়েলের অভিযানে হুতিরা ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে সমর্থন দিচ্ছে। লোহিত সাগরে ইসরায়েল অভিমুখে যাওয়া কিংবা ইসরায়েলের পতাকাবাহী যে কোনও জাহাজকে হামলার নিশানা করার হুমকি দিয়েছে তারা। তেল ও জ্বালানির চালান নিয়ে যাওয়ার জন্য লোহিত সাগর বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচল পথ। কিন্তু এ পথে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজগুলো হুতিদের রকেট এবং ড্রোন হামলার শিকার হচ্ছে।

লোহিত সাগরের নৌপথে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল সুরক্ষিত রাখতে একটি আন্তর্জাতিক নৌ টহল অভিযান শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাহিনী হুতিদের ড্রোনগুলো ভূপাতিতও করছে। ২৩ ডিসেম্বরে লোহিত সাগরে ভারতীয় পতাকাবাহী একটি তেলের ট্যাঙ্কারে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র। একইদিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর জানায়, ইরান থেকে ছোড়া একটি ড্রোন ভারত মহাসাগরে রাসায়নিক একটি ট্যাংকারে আঘাত হেনেছে।

মেরিটাইম সিকিউরিটি ফার্ম আম্ব্রে বলছে, ভারত মহাসাগরে এমন হামলা এটিই প্রথম। যুক্তরাষ্ট্র এ হামলার জন্য সরাসরি ইরানকে দায়ী করে জানায়, ‘কেম প্লুটো’ ট্যাংকারে আঘাত হানে ইরান থেকে ছোড়া ওয়ান-ওয়ে অ্যাটাক ড্রোন। ইরান এই হামলার ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেনি। কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ করা নিয়ে ওই অঞ্চলে উত্তেজনা বেড়েছে।

ইউক্রেইনে যুদ্ধ এখনও চলছে। গাজায় যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষণ নেই- ফলে নতুন বছরে রক্তক্ষয় চলবে বলেই আশঙ্কা। ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে এরই মধ্যে বিশ্ব খাদের কিনারায় পৌঁছেছে। তার ওপর নতুন করে গাজায় যুদ্ধের প্রভাবে লোহিত সাগর, ভারত মহাসাগর এমনকি লেবানন-সহ বিভিন্ন স্থানে যে বিশৃঙখল পরিস্থিতি ঘোঁট পাকিয়ে উঠছে তাতে আরেক মানবিক-অর্থনৈতিক সংকটময় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথেই পা বাড়াচ্ছে বিশ্ব।