8 September 2024 , 5:56:53 প্রিন্ট সংস্করণ
রাজশাহী-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম একজন ব্যবসায়ী থেকে হয়েছেন রাজনীতিবিদ। ২০০৮ সালে প্রথম নির্বাচনে শাহরিয়ার আলম ঋণগ্রস্ত থাকলেও মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে তিনি হয়েছেন কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। তার বিত্ত-বৈভবের উত্থান দেখে মনে হবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি পেয়ে বসেছিলেন আলাদ্দীনের চেরাগ। রাজনীতিবিদ না হয়েও তিনি রাজনীতির মাঠে হয়ে উঠেন মাফিয়া ডন। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই প্রতিবাদকারীদের যেতে হয়েছে জেলে।
এভাবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি তার নির্বাচনি এলাকা চারঘাট-বাঘা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন, আবাদী জমি, বিভিন্ন ধরনের বাগান, ফ্ল্যাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আর এসব করে জমিয়েছেন কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ। তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা যায়, ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় চারঘাট-বাঘায় হঠাৎ করেই আবির্ভূত হোন শাহরিয়ার আলম। কিছু খাদ্রসামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে চারঘাট-বাঘার মানুষের কাছে পরিচিতি পান গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শাহরিয়ার আলম। এর পর অনেকটা কাকতালীয়ভাবে আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবির্ভূত হোন শাহরিয়ার আলম।
এর পর হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে ২ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার। বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকার। আর নিজের কোম্পানির নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ দেখান। অর্থাৎ এই সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুই ছেলের অস্থাবর সম্পদ ছিল মাত্র ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৬৬২ টাকা। পাঁচ বছরেই তাদের অস্থাবর সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৭ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৪৮২ টাকা। তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০৮ সালে শাহরিয়ার আলম সম্পদশালী না হলেও গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি অবৈধ পন্থায় হয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক।
নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে গড়েছেন বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ ব্যাপক সম্পদ। তার উত্থান দেখে মানুষের ধারণা তিনি যেন পেয়েছিলেন আলাদ্দীনের চেরাগ। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে তার নির্বাচনি এলাকা চারঘাটে পোশাক কারখানা স্থাপনসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্পমূল্যে কিনেছেন কোটি কোটি টাকার জমি। চারঘাট-বাঘা মহাসড়কের পাশে মেরামতপুর এলাকায় অবস্থিত লিলি সিনেমা হল ২০১০ সালের বন্ধ হয়ে গেলে হল মালিকরা ভবনসহ জমিটি বিক্রির উদ্যোগ নেন।
ঢাকার এক সিনেমা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হলটি কিনে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ২০১৪ সালে শাহরিয়ার আলম প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর সিনেমা হলের জায়গাটি কিনে সেখানে গার্মেন্ট গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। সিনেমা হলের ৩৭ শতক জমি ভবনসহ কোটি টাকায় কেনার মানুষ থাকলেও গার্মেন্ট করার প্রলোভন দেখিয়ে হল মালিকদের কয়েকজন অংশীদারকে রাজি করান শাহরিয়ার আলম। পরে বাকি অংশীদারদের চাপে ফেলে মাত্র ৫০ লাখ টাকায় ৩৩ শতক জমি ও ভবনসহ সিনেমা হল কিনে নেন তিনি। কিন্তু ১০ বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে গার্মেন্টসের একটি পিলারও ওঠেনি। ২০২২ সালে চারঘাট সদরে উপজেলা ভূমি অফিসের পূর্ব পাশে বিশ্বনাথ রমেকা নামে এক ব্যক্তির কাছে থেকে ৩৩ শতাংশ জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। এ ছাড়াও বাঘা, লালপুর ও ঈশ্বরদীতে বিভিন্ন নামে-বেনামে শাহরিয়ার আলমের আরও জমির কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
বাঘা উপজেলার পার্শ্ববর্তী নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের এক নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাহরিয়ার আলম। এরপর প্রথম স্ত্রী আয়েশা আক্তার ডালিয়াকে তালাক দেন তিনি। পরে প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ পন্থায় দ্বিতীয় স্ত্রী লেনির মা রোকসানা মর্ত্তুজা লিলিকে ২০২১ সালে মেয়র বানান শাহরিয়ার আলম। দ্বিতীয় স্ত্রী লেনিকে লালপুরে কয়েক কোটি মূল্যের বাড়ি করে দেন শাহরিয়ার। ঢাকার গুলশানে ৩ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের রাজকীয় একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন লেনিকে।
অপর দিকে একই সময় গুলশানে নিজের নামে দুটি ও ছেলের নামে একটি ফ্ল্যান কিনে তিনি। নিজের নামে কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ৫১ বিঘা। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যমতে, তখন শাহরিয়ার আলমের স্থাবর কোনো সম্পদ ছিল না। এ ছাড়া ২০২০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বসন্তপুর মোড়ের পাশে একই প্লটে ৪০ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। জমির মালিক ছিলেন বাঘা উপজেলার বাঘা পেট্রোলপাম্পের মালিক গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগ, জমির মূল্য পরিশোধ না করে শাহরিয়ার আলম প্রতারণার মাধ্যমে দখল নিয়েছেন সেই জমি।
এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায় ২০১০ সালে ২৫ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কিনে সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে খামারবাড়ি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর এসব জমি ও অর্থসম্পদ গড়ে তোলার নেশায় শাহরিয়ার আলম তার নির্বাচনি এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন। তিনি তার এপিএস সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগেও করেন বাণিজ্য। চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজেও এপিএসের মাধ্যমে নেন মোটা অঙ্কের টাকা।
প্রতিমন্ত্রীর তহবিলে টাকা না দিলে কারও টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও মিলেছে সরকারি বরাদ্দ। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম পর্যায়ে চারঘাটে ১১৮ টন গম/চালের আওতায় ১৮ প্রকল্প ও বাঘা উপজেলা ২২ প্রকল্পের বিপরীতে ১৬৮ টন চাল/গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। একইভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া হয় আরও ২৫০ টন চাল/গম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাঘা-চারঘাট এলাকায় ২৩০ প্রকল্পের আওতায় দুই পর্যায়ে ৬০০ টন চাল/গম বরাদ্দ করা হয়।
এভাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দুই পর্যায়ে ৫২টি প্রকল্পের আওতায় চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় ১০০ টন চাল/গম বরাদ্দ হয়। এ ছাড়া প্রতিবছরই প্রায় ১ কোটি টাকা হারে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশে। কিন্তু শেরিভাগ বরাদ্দই তছরুপ হয়েছে বলে দাবি এলাকাবাসীর। শাহরিয়ার আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবার আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হওয়ার সময় ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা দামের হোন্ডা সিআরভি মডেলের গাড়িতে এবং স্ত্রী ২৭ লাখ টাকা দামের নিশান এক্স-ট্রায়াল গাড়িতে চড়তেন।
সর্বশেষ তাকে ১ কোটি ১ লাখ ৩ হাজার ১০০ টাকা দামের লাক্সারি গাড়িতে এবং তার স্ত্রীকে ১ কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা দামের গাড়িতে চড়তে দেখা যায়। এ বিষয়ে সাবেক সাংসদ ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।