শিক্ষা

বাংলাদেশে এক বছরে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা অধিকাংশই নারী

বাংলাদেশে এক বছরে আত্মহত্যা করেছেন ৫১৩ জন শিক্ষার্থী৷ যাদের মধ্যে ৬০ ভাগেরও বেশি নারী শিক্ষার্থী৷ আরো উদ্বেগের বিষয়, যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে ৪৪ ভাগেরও বেশি স্কুল শিক্ষার্থী৷ বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আচঁল ফান্ডেশন’ শনিবার তাদের এক জরিপে এই তথ্য প্রকাশ করেছে৷সংগঠনটি জানিয়েছে, আত্মহননকারীদের মধ্যে প্রায় ১০ ভাগ মানসিক সমস্যার কারণে এই পথ বেছে নিয়েছেন৷ আর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ গবেষণা বলছে কিশোর-কিশোরীদের প্রায় ১৩ ভাগ মানসিক রোগে আক্রান্ত৷

আর দেশের তিন কোটি মানুষ মানসিক রোগাক্রান্ত৷আঁচল ফাউন্ডেশন তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালেল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷ তবে ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৫৩২ জন৷সংগঠনটি জানিয়েছে, নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি৷ আত্মহননের পথ বেছে নেয়াদের মধ্যে ৬০ দশমিক ২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী৷ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের তুলনায় স্কুলমুখী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করেছে তারা৷

তার পরিমাণ ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ৷২০২৩ সালে যে ৫১৩ জন আত্মহত্যা করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন ২২৭ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ১৪০ জন কলেজ শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন এবং ৪৮ জন মাদরাসা শিক্ষার্থী৷আত্মহননকারীদের মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগের নাম৷ এই বিভাগের অন্তত ১৪৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ এরপর চট্টগ্রাম বিভাগের ৮৯ জন, রাজশাহী বিভাগের ৭৭ জন, খুলনা বিভাগের ৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন৷ তালিকার পঞ্চম স্থানে যৌথভাবে রয়েছে বরিশাল ও রংপুর বিভাগের নাম৷

আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৩ জন৷ ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ জন এবং সিলেট বিভাগের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷সাধারণভাবে আত্মহত্যার কারণ হিসাবে অভিমান, প্রেম, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক কলহ, পারিবারিক নির্যাতন, পড়ালেখার চাপ, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পারা, যৌন হয়রানি ও অপমান বোধের মত বিষয়গুলো উঠে এসেছে আঁচলের প্রতিবেদনে৷সংগঠনটি জানিয়েছে, ১৩-১৯ বছর বয়সি ৩৪১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যা মোট আত্মহননকারীর ৬৬ দশমিক ৫ ভাগ৷

আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০২২ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সামান্য কম৷ কিন্তু এটা আসলে কমার কেনো প্রবণতা নয়৷ সামনের বছর দেখা যাবে আবার বেড়ে গেছে৷ আত্মহত্যার কারণ দূর করার কেনো সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ আমরা দেখছি না৷তিনি আরো বলেন, ‘‘চূড়ান্ত হতাশা থেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷এর পেছনে অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ আছে৷ সেগুলো এখনও বিদ্যমান৷ সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অস্থিরতা, যারা এসব নিতে পারেন না তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷

যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন বা পড়া শেষ করেছেন তাদের ওপর পরিবারের চাপ আছে চাকরি বা কর্মসংস্থানের৷ সমাজও তাদের নানা কথা বলে৷কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে পরিবারের সদস্য এবং বাইরের লোকজনের সঙ্গে ‘জেনারেশ গ্যাপ’ দিন দিন বাড়ছে জানিয়ে তানসেন রোজ বলেন, ‘‘যা তাদের হতাশা ও আত্মহত্যার মূল কারণ৷বাংলাদেশে এখন মোট জনগোষ্ঠীর ১৮ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছেন৷ ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় বলা হয়, ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৪৮ দশমিক ৪ ভাগ মানসিক রোগী৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ৩৪৭ জন রোগীর ওপর গবেষণা করে ওই তথ্য প্রকাশ করেছে৷ ওই রোগীদের মধ্যে ১৬৮ জন কেনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছিলেন৷পোশাক কর্মী এবং তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘মনের বন্ধু’ এর প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদা শিরোপা৷ তিনি বলেন, ‘‘পোশাক কর্মীদের ২০ ভাগ নানা ধরনের মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে থাকেন৷ তারা মূলত তাদের পরিবার, সন্তান ও তাদের ভবিষ্যত নিয়ে চাপে থাকেন৷ মানসিক অস্থিরতায় থাকেন৷ আর তরুণদের মধ্যে যারা নারী, তাদের ৫০ ভাগ এবং পুরুষদের ৩০ ভাগ এখন মানসিক অস্থিরতার মুখে আছেন৷

তিনি জানান, তরুণীরা মূলত নানা রকম আ্যাবিউজের মধ্য দিয়ে যান, যা তাদের মানসিকভাবে পীড়িত করে৷ আর তরুণেরা নানা ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক চাপে পীড়িত হন৷জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘২০০৫ ও ২০০৬ সালের গবেষণায় আমরা দেখেছি, তখন দেশের ১৬ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগী ছিলেন৷ ২০১৮ সালে তা হয়েছে ১৮ শতাংশ৷ মানসিক রোগী বাড়ছে, তবে তার চেয়ে আত্মহত্যার হার বাড়ছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই বাড়ছে৷

কারণ হিসাবে তিনি দায়ী করেন, সামাজিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, অসহিষ্ণুতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া, পরমত সহিষ্ণুতার অভাব, মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, মাদকাসক্তি এবং মানুষের যন্ত্র নির্ভরতাকে৷এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যে তরুণেরা মানসিক সমস্যা নিয়ে আসেন তাদের অধিকাংশই পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বা তারা তাদের দক্ষতা দিয়ে টিকতে পারছেন না৷মানসিক চাপই কাউকে কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে আত্মহত্যা ফৌজদারী অপরাধ ও পাপ হিসেবে গণ্য হয়৷ ফলে কারো মধ্যে কোনো কারণে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগলেও ভয়ে সে তা প্রকাশ করেন না৷ তাই আমাদের আইন ও মানসিকতার পরিবর্তন দরকার৷

%d bloggers like this: