এক্সক্লুসিভ

নাসিরের বাগানে হেমন্ত বরণ

গড়াই নদীর কূল ঘেঁষে সরু পাকা সড়ক। এরই পাশে দৃষ্টিনন্দন বাগান। গাছের নিচে বিছানো ত্রিপলে রং-তুলি ও কাগজ নিয়ে বসেছে অর্ধশতাধিক শিশু। তারা আকঁছে হেমন্তকালের নদীতে নৌকা, আকাশে ভাসা মেঘ, কাঁশফুল, পাখি, প্রকতি জীবনের চিত্র। বাগানে আছে দোলনা, পাঠাগার, জাদুঘর, শরীরচর্চার সামগ্রী ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির গাছ। কোনো কোনো শিশু খেলা করছে, কেউবা বই পড়ছে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে নাসির উদ্দিনের বাড়ির বাগানে গতকাল শুক্রবার সকাল পৌনে ১১টায় সরেজমিন গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। যেন শিশুদের মিলন মেলা। এসময় ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী নাফিজা জানায়, এখানে সব ঋতুতেই উৎসব হয়। ছবি আঁকতে আসি। খুব ভাল লাগে। এবার হেমন্তকালের নদীতে নৌকা, আকাশে মেঘ ভাসা, কাঁশফুল বনের ছবি এঁকেছি। উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে এই কয়া গ্রাম। এক পাশে গড়াই এবং অপর পাশে পদ্মা নদী। প্রাচীন নিদর্শন ও গ্রামীণ জীবনের নানা উপকরণ সংরক্ষণ করেন ৭৫ বছর বয়সী নাসির উদ্দিন। শুক্রবার এলেই শিশুনিকেতনে পরিণত হয় তাঁর বাগান। তিনি বলেন, শিশুদের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চাই। শিশুদের জন্য গড়তে চান স্বর্গরাজ্য। ৩৩ শতাংশ জমির ওপর বাগানসহ তাঁর বসতভিটা। রয়েছে বিনোদন ও শরীরচর্চা কেন্দ্র, পাঠাগার, জাদুঘর, সংবাদ সংগ্রহশালা। আশপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী শিশু আসে। তারা বই পড়ে, খেলা করে, বিলুপ্তপ্রায় হরেক প্রজাতির গাছের সঙ্গে পরিচিত হয়। জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র দেখে চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের স্পর্শ অনুভব করে। তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের তাঁর বাগানে আসতে বলেন। বই পড়তে উৎসাহিত করেন। পাঠাগার গড়ে তুলতে স্থানীয় শিক্ষিত মানুষকে উৎসাহ দেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে পেনশনের টাকায় শিশুদের বিনোদন ও মেধা বিকাশের জন্য বাড়ির আঙিনায় বাবা-মায়ের নামে ‘কুলছুম নেছা-জালাল গান্ধী শিশুপার্ক’ গড়ে তোলেন। ৫০ বছর ধরে বিলুপ্তপ্রায় গাছ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বাগানে প্রায় ২০০ প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনকারী গাছ আছে। প্রতিটি গাছে কাগজের ওপর লেমিনেটিং করে নাম লেখা আছে, যাতে শিশুরা পড়ে চিনতে পারে। বাগানে আছে বনকাঁঠাল, লাটা, ঢেপড়, ফলশাহী, মিষ্টি আমলকী, করমচা, জামরুল, হরগৌড়ি ইত্যাদি গাছ। নাসির উদ্দিন বলেন, বিলুপ্তপ্রায় ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভাবর্ধনের গাছ সংরক্ষণে তিনি চেষ্টা করছেন। বাগানে বেশির ভাগই ঔষধি গাছ। যার যখন খুশি প্রয়োজন মতো নিয়ে যাচ্ছেন। বাগানের মাঝখানে একটি ছোট্ট আধাপাকা ঘরে মায়ের নামে একটি পাঠাগার, জাদুঘর। পাশেই সম্প্রতি সরকারি উদ্যোগে আধাপাকা ঘর করা হয়েছে। সেখানে সংবাদ সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন তিনি। পাঠাগারে শিশুদের মেধা বিকাশ, শরীর গঠনবিষয়ক বইসহ পাঁচ শতাধিক পুস্তক আছে। জাদুঘরে সেন ও পাল বংশ এবং ব্রিটিশ আমলের ইট, থালা, পানের বাটা, বিলুপ্তপ্রায় হারিকেন, ঢেঁকি, পালকি, ডাক টিকিট, ছক্কা, নাঙল, মাথাল, ঢালসহ শতাধিক উপকরণ আছে। সংবাদ সংগ্রহশালায় শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি ও নানা বয়সী শিশুদের লেখা এবং দেশ-বিদেশের আবিষ্কারক বিষয়ক পত্রিকা ও পত্রিকার কাটিং রাখা হয়েছে। নাসির উদ্দিন জানান, তাঁর নানি ও মায়ের ব্যবহৃত পানের বাটা, পান ছেঁচনি ও চিনামাটির পুতুল দেখে তিনি জাদুঘর স্থাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক উপকরণ সংরক্ষণ করেছেন। এগুলো থেকে শিশুরা প্রাচীনকাল সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। শিশুদের মনের যে খোরাক, তা নাসির স্যারের এখান থেকে পূরণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়া মন্ডলপাড়ার গৃহিণী মোছা. রওশনআরা। তিনি বলেন, হেমন্তঋতুর বরণ উপলক্ষ্যে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতায় মেয়েকে নিয়ে এসেছি। এখানে পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবসহ নানা পার্বণে নাসির স্যার শিশু-কিশোরদের নিয়ে আনন্দ আয়োজন করেন। এ ছাড়াও গাছে ফল পাকলে শিশুদের নিয়ে উৎসব হয় বাগানে। আনন্দ করে ফল খায় শিশুরা। কয়া ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী আছিয়া খাতুন জানায়, নাসির স্যার বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তাঁর আচরণ শিশুর মতো। গাছ, পাখি ও বই যাদের ভালো লাগে, তারা ছুটে আসে বাগানে। অনেক শেখার আছে সেখানে। কয়া গ্রামের আকাশ আহমেদ তাঁর দুইটি শিশু নিয়ে বাগানে এসেছিলেন এইদিন। তিনি বলেন, নাসির স্যার একজন সাদামনের মানুষ। পেনশনের টাকায় শিশুদের বিনোদন দিচ্ছেন। নাসির উদ্দিনের মতো আলোকিত মানুষ দেশের কল্যাণে অনেক অবদান রাখেন বলে মনে করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি জানান, গতবছর তিন লাখ টাকা সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভবিষ্যতে আরো উদ্যোগ নেওয়া হবে।