ভিন্ন স্বাদের খবর

আজ সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথের ১৯২তম জন্মবার্ষিকী

আজ গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ১৯২তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ১৮৩৩ সালের আজকের এইদিনে তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুন্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হরিনাথ মজুমদার হলেও কাঙ্গাল হরিনাথ নামেই পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বাউল গান রচিয়তা। এ উপলক্ষ্যে আজ কুমারখালীতে সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে অবস্থিত প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, কবিতা প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। প্রধান আলোচক থাকবেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনেকশন এন্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের প্রভাষক তন্ময় কুমার সাহা। শনিবার (১৯ জুলাই) এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কুমারখালী কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের রেপ্লিকা মেনুফ্যাকচারার ও ইনচার্জ তাপস কুমার মন্ডল। জানা গেছে, কাঙ্গাল হরিনাথ সংবাদপত্রে দারিদ্র্য ও নাগরিক সচেতনতা বিষয়ে লেখালিখি করতেন। প্রথম দিকে তিনি কবি ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ নিজ গ্রামের মানুষের ওপর নির্যাতন ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। পরে নিজ উদ্যোগে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা বের করেন। প্রথমে এটি মাসিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ করা হলেও পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকীতে রূপান্তরিত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ ছাপা হতো। এ ছাড়া ব্রিটিশ নীলকরদের শোষণের বিভিন্ন ঘটনাও ছাপা হতো। ১৮ বছর রাজশাহীর রানী স্বর্ণকুমারী দেবীর সহায়তায় এটি চালানোর পর আর্থিক সংকট এবং সরকারের নিবর্তনমূলক আইনের কারণে বন্ধ করে দিতে হয়। ভারত উপমহাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ কাঙ্গাল হরিনাথের মাসিক পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’। বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের হিসাব করলে এটি থাকবে প্রথম দিকে। ১৮৬৩ সালের এপ্রিলে কুমারখালী থেকে যখন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা বের করা হয়, উপমহাদেশের প্রথম ‘আধুনিক সংবাদপত্র’ প্রকাশের সময়কাল তখন সবে ৮৩ বছর। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা আরেকটি জায়গায় অন্য সংবাদপত্র থেকে আলাদা। উপমহাদেশের প্রথম দিকের অধিকাংশ পত্রিকাই ছাপা হতো বড় শহর থেকে। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা ১৮৬৪ সাল থেকেই কুমারখালীতে স্থাপিত ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়। গ্রামীণ এলাকা থেকে এমন মুদ্রিত সংবাদপত্রের সংখ্যা সব বিচারেই নগণ্য। আর্থিক সংকট ও ব্রিটিশদের নিবর্তনমূলক আইনের কারণে ১৮ বছর পর বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক সেই ছাপাখানা এত দিন সংরক্ষিত ছিল কাঙ্গাল হরিনাথের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। পরে ২০ লাখ টাকার চেক এবং পরিবারের দু’জনের চাকরির বিনিময়ে ২০২৩ সালে সেই ছাপাখানাটি নেওয়া হয়েছে ২০১৭ সালে কুমারখালীতে প্রতিষ্ঠিত কাঙ্গাল হরিনাথের স্মতি জাদুঘরে। তবে ছাপাখানাটি জাদুঘরের সুরক্ষিত থাকলেও আজও অবহেলায় অরক্ষিত তাঁর বাস্তুভিটা ও সমাধি। এতে ক্ষুব্ধ কাঙ্গাল হরিনাথের বংশধর, লেখক, গবেষক ও সাংবাদিকরা। শনিবার (১৯ জুলাই) দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কুমারখালীর কুন্ডুপাড়া এলাকায় অবস্থিত কাঙ্গাল হরিনাথের বাস্তুভিটাটি অবহেলা – অযতেœ পড়ে আছে। খসে খসে পড়ছে দেওয়ালের ইটগুলো। নেই সীমানা প্রাচীর। আর সমাধিঘরের সামনে মরিচাধরা জরাজীর্ণ টিনের বারান্দা। বাঁশ ও সিমেন্টের খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দেওয়া। বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে পড়ে। বারান্দার প্রাচীর দেওয়াল মাটির তৈরি। বৃষ্টি হলেই সমাধির সামনে জমে থাকে হাঁটুসমান পানি। এসব নিয়ে অভিমান করে প্রথমে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে অপরাগ স্বীকার করেন কাঙ্গাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধর অশোক মজুমদারের স্ত্রী শ্রীমতী গীতা মজুমদার। পরে আক্ষেপ করে বলেন, কত সরকার আসলো- গেল। কাঙ্গাল সে কাঙ্গালই রয়ে গেল। ছাপাখানা জাদুঘরে থাকলেও, অবহলিত ও অরক্ষিত বাস্তুভিটা ও সমাধি। সাংবাদিকরাও খোঁজ রাখেনা। ইউএনও, ডিসিরাও আসেনা। এসব আর বলতে চাইনা। আমরা কাঙ্গালের বংশধর হিসেবে যতটুকু পারছি, তাঁকে ধারণ করছি।

জানা গেছে, ১১ দফা দাবি নিয়ে আশির দশকে কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ গঠন করা হয়। সেটির কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। ওই পরিষদের সদস্য এবং কবি ও নাট্যকর লিটন আব্বাস বলেন, কাঙ্গালের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালন, পাঠ্যপুস্তকে জীবনী লিপিবদ্ধ, বাস্তুভিটা ও সমাধি সংরক্ষণ, কাঙ্গালের লেখালেখি, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি, স্মৃতিসমূহ সংরক্ষণসহ ১১ দফা দাবি ছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি আজও। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি ভবিষ্যত প্রজন্ম ও ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। কুমারখালী কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের রেপ্লিকা মেনুফ্যাকচারার ও ইনচার্জ তাপস কুমার মন্ডল বলেন, সমাধি ও বাস্তুভিটা সংরক্ষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। সরেজমিন পরিদর্শন করে বংশধর এবং জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম।