8 September 2024 , 3:11:23 প্রিন্ট সংস্করণ
পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্য্যুনালের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। নিয়োগ পাওয়ার পর রবিবার আনুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। কোন প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনা সম্ভব তাও জানান তাজুল ইসলাম।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যার অভিযোগে সারাদেশে এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগ মামলায়ই প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বিষয়টি উল্লেখ করে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু বেশিরভাগ মামলায় প্রধান আসামি শেখ হাসিনা, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যে আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে, সেটি আমরা শিগগিরই শুরু করবো।
এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে হওয়া প্রত্যাবর্তন চুক্তিটির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেণ, ২০১৩ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তিনি গণহত্যার প্রধান আসামি হবেন বলে আমরা মনে করছি, অধিকাংশ মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। সুতরাং এই প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে আমরা আইনগতভাবে শেখ হাসিাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করব।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ পর্যন্ত যারা আসামি হয়েছেন এবং তদন্তের পর যারা হবেন- তাদের অনেকে দেশের বাইরে চলে গেছেন, অনেকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আমাদের চেষ্টা থাকবে, এমন কেউ যেন দেশের বাইরে যেতে না পারেন। কারণ, আসমি যদি বাইরে চলে যায়, তবে বিচার করা অসম্ভব হবে। তাই আমরা আইন প্রয়োগকারী সকল সংস্থার কাছে চিঠি পাঠাবো, এরা যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘কে কত বড় আসামি, কে কত বড় পদে ছিলেন, আইন সেটা দেখবে না। আইনের চোখে সবাই সমান। যিনি অপরাধ করেছেন, অপরাধের ধরণ দেখে তার সঙ্গে ব্যবহার করা হবে। সতরাং প্রধানমন্ত্রী হোক বা আইজিপি বা কোনো ক্ষমতাধর মন্ত্রী, তারা যখন আসামি হিসেবে কাঁঠগড়ায় দাঁড়াবেন, সেখানে সবাই সমান। তাদেরকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের বিষয়টি নিয়ে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আল্লাহ যাকে খুশি ক্ষমতা এবং সম্মান দেন, আবার যার থেকে খুশি সেসব কেড়েও নেন।’ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাস থেকে তা প্রমাণিত হয়েছে।তিনি বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে আমার দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল। ২০১০ সালে প্রথম এখানে দাঁড়িয়েছিলাম। তারপর দীর্ঘ সময় ছিলাম না।
আপনারা জানেন, আজ বাংলাদেশের কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমি এই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। মনে হয় একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রে, ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আমাকে প্রধান প্রসিকিউটর করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘একটা যুদ্ধের মাধ্যমে যখন দেশ স্বাধীন হয়, বোমায় বিল্ডিংগুলো এবং রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যায়।
আমাদের বিল্ডিংগুলো হয়তো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি, কিন্তু রাষ্ট্রের অবকাঠামোগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্র-জনতার মাধ্যমে আমাদের এমন একটা বিপ্লব হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী, তার মন্ত্রী-এমপি-আমলা এমনকি অনেক মসজিদের ইমাম পর্যন্ত পালিয়ে গেছেন। স্বৈরশাসকরা দেশটাকে এমন একটা অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, এই মানুষগুলো পালাতে বাধ্য হয়েছে।
দেশে গণহত্যা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। হাজারো মানুষ হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। এই গণহত্যার বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করা হয়েছে। আমাদের প্রায়োরিটি হচ্ছে, যেহেতু এই ঘটনাগুলো খুবই তাজা, এই এভিডেন্সগুলো যারা পারপিট রাউটার্স আছেন, যারা আসামি হবেন এই মামলাগুলোতে, তারা কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আছেন, অনেকে দায়িত্বেও আছেন, তারা চেষ্টা করছে আলামত ধ্বংস করার।
তিনি বলেন, ‘তাই আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে, এই গণহত্যার যে আলামত আছে, সেগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংরক্ষণ করা। এরপর সেগুলো তদন্ত সংস্থার হাতে দিয়ে আসা, যাতে সঠিক সময়ে আমরা আলামতগুলো আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে পারি।তাজুল ইসলাম আহ্বান জানান, ‘আমাদের ছোট ভাইয়েরা, জনতা- যারা আন্দোলনের সময়ে রক্ত দিয়েছেন, ফিল্ডে ছিলেন, যাদের চোখের সামনে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে, তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, আপনারা আপনাদের চোখে দেখা, হাতে থাকা যেসব এভিডেন্স আছে, শহীদ এবং আহতদের তালিকা আছে, কারা এগুলো ঘটিয়েছে তাদের তালিকা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর টিম কিংবা তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দিন।
যাতে আমরা প্রোপার তদন্তের মাধ্যমে একটা সঠিক এবং ন্যায়বিচার করতে পারি। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে গণহত্যাকারী স্বৈরশাসনের পতনের পর সাধারণ জনতা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেছেন। এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটা ন্যায় প্রদান করা। যারা এই অপকর্মগুলো করেছে, তাদের যদি একটি সঠিক বিচারের মাধ্যমে সাজা দেওয়া যায়, তবে সাধারণ মানুষ প্রতিশোধ পরায়ণতা থেকে ফিরে আসবে।
সমাজ যাতে বিভাজিত হয়ে না যায়, সে জন্য যারা ঠান্ডা মাথায় আমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করেছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তিনি বলেন, ‘এই প্রায়োরিটির অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ন্যায়পরায়ণ, সৎ এবং সাহসী বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হবে। তদন্ত সংস্থায়ও যোগ্য মানুষ আসবেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আমরা একটা সুষ্ঠু বিচারের ব্যবস্থা করব। এটা এমন একটা বিচার হবে যে, বিচারের পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, বাদীপক্ষসহ আসামিপক্ষ মনে করবেন যে, তারা উপযুক্ত প্রতিদান পেয়েছেন।
আমরা সেই পরিবেশ তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা চাইবো না যে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো, গুমের শিকার পরিবারগুলো, নির্যাতন এবং নিপীড়নের শিকার পরিবারগুলো দীর্ঘদিন বিচারের দাবিতে কান্না করুক। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই ট্রাইব্যুনালকে সক্রিয় করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার চেষ্টা থাকবে আমাদের।