জাতীয়

সেই আনন্দ আয়োজনের রাত এক আগুনে পরিণত হয় বিষাদপুরীতে

সেই আনন্দ আয়োজনের রাত এক আগুনে পরিণত হয় বিষাদপুরীতে

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন তল্লাশি শেষ করে একে একে নেমে আসছিলেন রাত ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে, তখনও আগুনে পোড়া ভবনটির সামনে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা আগেও বেইলি রোডের যে জায়গা ছিল জমজমাট এক আনন্দ আয়োজনের উৎসব স্থল সেখানে কারও মুখে কোনো কথা নেই। টুকরো টুকরো জটলায় কান পাতলেই শোনা যায়, এক আগুনে কী হয়ে গেল।

সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) বেইলি রোডের এ অংশের খাবার দোকানগুলোতে বরাবরই ভিড় থাকে। এদিন রাতও ছিল অন্য এক রাতের মতই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর খাবারের স্বাদ নিতে কিংবা স্বজনদের সঙ্গে খাবার আনন্দ ভাগ করতে তারা এসেছিলেন ছোট ছোট দলে। সেই আনন্দ আয়োজন এক আগুনে পরিণত হয় বিষাদপুরীতে।

রাত পৌনে ১০টার দিকে হঠাৎ আগুনে শুরু হয় ছুটোছুটি। চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায় আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে। পথচারী আর আশপাশের দোকান ও ভবন থেকে মানুষ ভিড় করতে শুরু করে আগুন লাগা আটতলা গ্রিন কোজি কটেজ ঘিরে।

নিচ থেকে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে ভবনের বিভিন্ন তলায় থাকা মানুষের বের হওয়ার কঠিন হয়ে পড়ে। এলোমেলো ছু্টোছুটি শেষে সবাই গিয়ে জড়ো হতে থাকেন উপরের দিকে। এক পর্যায়ে নিচ থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুন আর ধোঁয়া থেকে বাঁচতে সবাই ভিড় করেন ছাদে।

এরমধ্যেই ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের একের পর এক ইউনিট। এগুলোর কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আটকা ব্যক্তিদের উদ্ধারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। শুরুতে আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে আহত ৫ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর খবর আসে। পরে আহত ও আগুনে দগ্ধ সেই সংখ্যা ১৫ হয়ে ৫০ ছাড়ায়।

আগুন নেভানোর মধ্যেই নারী ও শিশুসহ জীবিত ৭৫ জনকে উদ্ধার করা হয়। ছাদে জড়ো হওয়াদের মধ্যে অচেতন অবস্থায় ৪২ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর তথ্য দেয় ফায়ার সার্ভিস।আগুন নেভানোর আগে প্রথমে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য আসে। এরপরই মৃতের সংখ্যা বেড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিভিয়ে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। এরপরই আসতে থেকে একের পর এক মৃত্যুর খবর। প্রথম তিনজন এরপর তা বেড়ে ১১ এবং ২০ জনের খবর আসে হাসপাতাল থেকে। শেষমেষ রাতে ৪৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।

দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন পুরোপুরি নেভানোর পর রাত ১২টা ১০ মিনিটে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের তথ্য দেয় ফায়ার সার্ভিস।এরপর গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটির আটতলার সব জায়গা তল্লাশি শেষে রাত ১টা ৫৫ মিনিটে রাতের মতো উদ্ধার অভিযান শেষের কথা জানানো হয় বাহিনীর পক্ষ থেকে।

আগুনে পুরো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দৃশ্য রাতের অন্ধকারেও টের পাওয়া যাচ্ছিল বাইরে থেকে। সবগুলো কাচ ভাঙা। রাত ৩টার দিকেও পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা পুরো ভবন ঘিরে রেখেছেন।ভবনটির দোতলায় ছিল বিরিয়ানির পরিচিত খাবার দোকান কাচ্চি ভাই এর শাখা, পোশাকের ব্র্যান্ড ইলিয়েন, নিচের তলায় স্যামসাং এর শোরুমসহ আরও বেশ কিছু দোকান।

নিচ তলায় স্যামসাংয়ের শোরুমের পাশে রয়েছে একটি কফি শপ। এরকম কফির দোকানসহ ফাস্টফুডের অনেকগুলো দোকান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে ভবনটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

কাচ্চি ভাইয়ে ৫০% ছাড়ের কারণে ছিল উপচেপড়া ভিড়?

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন একে একে রাত ২টার দিকে বেরিয়ে আসছিলেন তখনও অনেকে ভবনটির সামনে ভিড় করেছিলেন। তাদেরই একজন সোহেল আকবর। রাত ৯টা ৫০ এর দিকে যখন আগুন লাগে তখন কাচ্চি ভাই থেকে খাবার কিনতে সেদিকে যাচ্ছিলেন। লাইন লম্বা থাকায় ভবনের আগেই অপেক্ষায় ছিলেন। এরপরই আগুনের খবরে ছুটোছুটি শুরু হয়। তারও আর ঢোকা হয়নি ভবনে।

রাত ২টার দিকে যখন কথা বলছিলেন তখনও যেন তার শিহরিত হয়ে উঠছিলেন ঘটনার ভয়াবহতার কথা ভেবে। তিনি ঢোকার পর যদি আগুন লাগত তাহলে কী হত তা ভেবে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল তার।সোহেল বলেন, কাচ্চি ভাইয়ে ৫০ শতাংশ ছাড় থাকায় সেখানে ছিল অসম্ভব ভিড়। হেঁটে ভবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় কালো ধোঁয়া দেখতে পান। সেই থেকে আগুন নেভার অনেকপরও তিনি যেন সম্মোহিতের মত এখনও রয়ে গেছেন ঘটনাস্থলে।

আগুন নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলায় ছড়িয়েছে?

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে ধারণার কথা বলেছেন। ভবনটির প্রতিটি ফ্লোরেই গ্যাসের সিলিন্ডার ছিল বলেও জানিয়েছেন বাহিনীটির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়া জেনারেল মঈন উদ্দিন। তার কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় সেখান দায়িত্বপালনরত র‍্যাব-৩ এর এএসপি কামরুল হাসানের দেওয়া তথ্যে।

রাত আড়াইটার কিছু পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলেন, স্যামসাং শোরুমের পাশের কফি হাউস থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা নিচ থেকে আগুন উপরের দিকে উঠেত দেখেছেন। প্রথমে দোতলায় তারপর তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে যায়।ভবনটির একদিকে আরেক ফাস্টফুড ব্র্যান্ড কেএফসি ও পিৎজা হার্টের আউটলেট। আরেক পাশে পোশাকের অঞ্জনস’ এর বিক্রয়কেন্দ্র, যার পাশেই সুইস বেকারির অবস্থান।

শ্বাসনালি পুড়েই মৃত্যু বেশি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল রাত পৌনে তিনটায় সাংবাদিকদের বলেন, যারা মারা গেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। যে ২২ জন চিকিৎসাধীন তাদেরও প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে এবং সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

মর্মস্পশী ‘গল্প’ রেখে চলে গেলেন যারা

গভীর রাতেএ প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, নিহতদের মধ্যে বুয়েটের দুই শিক্ষার্থী নাহিয়ান ও লামিসা ইসলামের লাশ হাসপাতালে পেয়েছেন তাদের স্বজনরা। লামিসার বাবা পুলিশের একজন অতিরিক্ত ডিআইজি। ভিকারুন্নেসা স্কুলের শিক্ষক লুৎফুন নাহার ও তার মেয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জান্নাতি তাজরীনকে মর্গের লাশের ভিড়ে খুজে পেলেন লুৎফুন নাহারের স্বামী গোলাম মহিউদ্দিন।

সেখানে তিনি আফসোস করছিলেন। বলছিলেন, তার স্ত্রী দাঁতের ব্যথায় ভুগছিলেন। দাঁত দেখাতে তারা হাসপাতালে যান। ফেরার পথে মহিউদ্দিনের ইচ্ছাতেই তারা কাচ্চি খেতে যান। সেখান থেকে লাশ হয়ে ফিরতে হবে এমন ভাবনা কে ভেবেছে!মালয়েশিয়ায় ফ্যাশন ডিজাইনিং এ পড়তেন রিয়া। লাস্ট সেমিস্টারের শিক্ষার্থী তিনি। ২ মার্চ তার ফ্লাইট।

ভিকারুননেসা পড়ুয়া ছোট বোন আরিশা ও সিটি কলেজে পড়ুয়া খালাতো বোন লিমুকে নিয়ে খেতে এসেছিলেন। রিয়ার বাবা কোরবান আলী পাগলের মত ঘুরছিলেন মেয়েদের খোঁজে।অবশেষে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের মর্গে মিলল তিন বোনের লাশ। পাগলের মত আচরণ করছিলেন কোরবান আলী।

নিমতলী-চুড়িহাট্টা-বনানীর পর বেইলি রোডে ভয়াবহ আগুন

নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানীর পর বেইলি রোডেও ভয়াবহ আগুন। রাজধানীতে গত ১৪ বছরে এনিয়ে চারটি স্থানে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটল। বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত ‘কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট’ ভবনে লাগা আগুনে এখন পর্যন্ত ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

এর আগে রাজধানীতে বড় তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে ছড়ানো আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়।২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক গুদামে আগুনে প্রাণ হারান ৭১ জন।২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৭ জনের মুত্যু হয়।

কারণ অনুসন্ধানে ফায়ারের ৫ সদস্যের কমিটি

রাজধানীর বেইলি রোডের ‘কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট’ ভবনে আগুনে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিটের চেষ্টায় দুই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও এখনও উদ্ধার অভিযান চলছে। ভয়াবহ এই আগুনের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির সভাপতি : পরিচালক(অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, কমিটির সদস্য সচিব ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন, সদস্য করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জোনের ডিএডি, সিনিয়র স্টেশন অফিসার এবং ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টরকে।

কমিটিকে সরেজমিন তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।এর আগে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার এরশাদ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টা ৫০ মিনিটে রাজধানীর বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আগুন লাগার সংবাদ আসে। সংবাদ পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে আমাদের ১২টি ইউনিট কাজ করছে।