জাতীয়

বছরজুড়ে আলোচনায় এই ৫ মন্ত্রী

বছরজুড়ে আলোচনায় এই ৫ মন্ত্রী

বিতর্কিত ভোটের মাধ্যমে ২০১৮ সালে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছিল বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দায়িত্ব গ্রহণের শেষ বছরে এসে বেশকিছু আলোচিত-সমালোচিত বক্তব্যের মাধ্যমে আলোচনায় ছিলেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী। এসকল মন্ত্রীর তালিকায় রয়েছেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

আলোচনায় ছিলেন ওবায়দুল কাদের : ‘খেলা হবে’ ও ‘তলে তলে’ বক্তব্যের জন্য বছরজুড়েই আলোচনায় ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘খেলা হবে ভোট চুরির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আগামী জানুয়ারিতে ফাইনাল খেলা হবে।’

গত ৩ অক্টোবর আমিনবাজারে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সমাবেশে তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেতারা এখন পথ হারিয়ে দিশেহারা। দুই সেলফিতেই বাজিমাত। এক সেলফি দিল্লিতে, আরেক সেলফি নিউ ইয়র্কে। শেখ হাসিনা দিল্লিতে, তারপরে গিয়ে নিউ ইয়র্কে বাজিমাত।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘কোথায় স্যাংশনস, কোথায় ভিসানীতি! তলে তলে আপস হয়ে গেছে, আপস হয়ে গেছে। দিল্লি আছে, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরাও আছি। শত্রুতা কারও সঙ্গে নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব।’

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘তলে তলে আপস’ হওয়ার বিষয়ে তোলপাড় করা বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে গত ৫ অক্টোবর সচিবালয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সেই বক্তব্যে তিনি ‘ভুল কিছু বলেননি’। ‘তলে তলে আপস মানে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন বা আমাদের সম্পর্ক ভালো আছে, আমি সেটা বোঝাতে চেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তলে তলে’যে বলি, সেটা পাবলিক খায়। সেজন্যই তো বলি- ‘খেলা হবে’।

‘বিএনপি’ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে চাপে কৃষিমন্ত্রী : গত ১৭ ডিসেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকারে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘(বিএনপির) ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার না করলে কি বাংলাদেশে আজ যে গাড়ি চলতেছে এই হরতালের দিন, আপনারা এই গাড়ি দেখতেন?… এছাড়া আমাদের জন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। কোনো অল্টারনেটিভ ছিল না। যেটা করেছি আমরা চিন্তাভাবনা করে করেছি।’ ‘বারবার বলা হয়েছে নির্বাচন কমিশন থেকে, তারা (বিএনপি) যদি নির্বাচনে আসে তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। (শুধু) পিছিয়ে দেওয়া নয়, বলাও হয়েছিল যে সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাদের জেলে না রাখলে দেশ অচল হয়ে যাবে।

কৃষিমন্ত্রীর এ বক্তব্যেও শোরগোল পড়ে যায়। বিব্রত হন খোদ আওয়ামী লীগের নেতারা। আব্দুর রাজ্জাকের এ বক্তব্য ‘সঠিক নয়’ দাবি করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এ বক্তব্য আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের নয়, এটি তার নিজস্ব বক্তব্য।এরপর ‘বেকায়দায়’ পড়ে ১৮ ডিসেম্বর আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের কাছে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে লিখিত বিবৃতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ওই বেসরকারি চ্যানেল কৃষিমন্ত্রীর পুরো বক্তব্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করেনি।

মন্ত্রীর খোলামেলা বক্তব্যকে কোনো কোনো মহল বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন যে, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং সত্য আপন জ্যোতিতেই উদ্ভাসিত থাকবে।

দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দিয়ে চাপে পড়েন শিল্প প্রতিমন্ত্রী : চলতি বছরের ১১ মে ইআরএফ আয়োজিত কর্মশালায় বক্তব্যে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ বাজারের যে অবস্থা তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট। অর্থনীতি ও বাজার দুই জায়গায়ই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দেশ এগিয়ে চলেছে, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু তারপরও দেশে আজ যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসার নামে আজ যে লুটপাট হচ্ছে, মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে- এগুলো সাংবাদিকদের আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বাজারে যাই তখন দেখি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কেন ঊর্ধ্বগতি? আমাদের কিন্তু কোনো কিছুর অভাব নেই। আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও সিন্ডিকেটের কারণে দেশের এ অবস্থা বিরাজ করছে।’ তার এ বক্তব্য আলোচনার জন্ম দেয়।পরে ১৬ মে একটি দৈনিকে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ওই সাক্ষাৎকারও আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না জানিয়ে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সচিবের কাছ থেকে মন্ত্রীর কাছে ফাইল চলে যায়। আমার কাছে ফাইল আসে না, কারণ কয়েকটি ফাইলে আমি উল্টো নোট দিয়েছি। আমি নেত্রীকে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সব জানিয়েছি।

আপনি বলেছেন অর্থনীতি ও বাজার- দুই জায়গায়ই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এ সিন্ডিকেট কারা তৈরি করেছে, সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ দিয়েছে কারা? জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘খামোখা নামটাম জিজ্ঞাসা করে আমাকে ভেজালে ফেলবেন। শেয়ার কেলেঙ্কারিতে কারা ছিল? তাদের অনেকেই এখন মন্ত্রী। মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে।

লিপস্টিক নিয়ে কথা বলে সমালোচনায় পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী : চলতি বছরের ৮ নভেম্বর সচিবালয়ে ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি মনিটরিং ও রিভিউ কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ‘সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব কাটানো সম্ভব হবে কি না’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এ প্রভাব অবশ্যই কাটানো সম্ভব হবে, আপনারা যদি পজিটিভ হন। সংবাদ মাধ্যমের প্রচার যদি পজিটিভ হয় যে, বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ সার্বিক কারণে এটি হয়েছে। অতএব এটাকে বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব ফেলা ঠিক হবে না। নির্ভর করে আপনারা কতটুকু ইতিবাচক হবেন।

আপনাদের তো এলাকায় গিয়ে ভোট চাইতে হবে, সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে অস্বস্তিতে আছে— এ প্রসঙ্গে টিপু মুনশি বলেন, ‘ধরেন, আমার এলাকা, আমার এলাকার মানুষের কষ্ট নেই। কারণ তারা আলুর দাম পাচ্ছে। আমার তো কৃষিনির্ভর এলাকা। একেকটা এলাকা একেক রকম। ঢাকা শহরে যে নির্বাচন করবে, তার অনেক সমস্যা। আজ থেকে ২০ বছর আগে আমার এলাকায় ১০টা মোটরসাইকেল ছিল, ২০০১ সালে আমি প্রথম ভোট করি। আজ হাজার হাজার মোটরসাইকেল। তারা প্রত্যেকে অ্যাফোর্ড করছে। আলু বেইজ তো আমার, কৃষি বেইজ তো! তাদের কোনো কষ্ট নেই। মহিলারা তিনবার করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে দিনে। চারবার করে স্যান্ডেল বদলাচ্ছে। অতএব আমার ভোট, আমি খুব ভালো জানি— আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সারাদেশের অবস্থাটা ভিন্ন। এটা আমি বুঝি, বিশেষ করে শহরের যারা দিনমজুর, নিম্নআয়ের মানুষ- তাদের কষ্ট হচ্ছে।’

লিপস্টিক লাগানো ও স্যান্ডেল বদলানোর এ বক্তব্য মুহূর্তে ভাইরাল হয়। সৃষ্টি করে ব্যাপক সমালোচনার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পিষ্ট মানুষ মন্ত্রীর এ বক্তব্য খুবই নেতিবাচকভাবে নেয়।

বক্তব্যে ‘জান্নাত-জাহান্নাম’ বিভ্রাট, সমালোচিত গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকীতে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত কর্মসূচিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বক্তব্যের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা কায়মনে দোয়া করবো বঙ্গবন্ধুকে যেন আল্লাহ জাহান্নামের ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়’।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী ও সাংবাদিকরা ফেসবুকে অনুষ্ঠানটি লাইভ ও ভিডিও ধারণ করেছিলেন। ফলে মুহূর্তে এ বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়। পরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভুলবশত তিনি ‘জান্নাত’ শব্দটি না বলে ‘জাহান্নাম’ শব্দ উচ্চারণ করেছেন। এটি ‘স্লিপ অব টাং (মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে)’। জাহান্নাম শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি সংশোধন করে জান্নাত শব্দটি ব্যবহার করি। পরবর্তী সময়ে কয়েকবার জান্নাত শব্দ উচ্চারণ করি।

পরে এ বিষয়ে ওই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৫ জন এক হয়ে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। এতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে দলীয় মনোনয়ন না দিতে অনুরোধ জানান তারা। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য জাকির হোসেন শেষমেশ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি।

আরও খবর

Sponsered content