রাজনীতি

বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত নয়

একদফা দাবি আদায়ে চূড়ান্ত ধাপের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই দেশজুড়ে ধরপাকড় আর মামলায় জর্জরিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। প্রতিদিনই দলটির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতাকর্মী আটক হচ্ছেন। তা ছাড়া নির্বাচন ঘিরে বিএনপিকে ভাঙতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নানামুখী তৎপরতা চালানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা। এক্ষেত্রে কোনো কোনো নেতাকে টাকা-পয়সা বা নির্বাচনে জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভনসহ নানা ধরনের সুবিধার কথা বলা হতে পারে বলে মনে করছে তারা। তবে দলের মধ্যে ভাঙনের ষড়যন্ত্র ও পরবর্তী নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত নয় বলে জানিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বরং তাদের একদফা দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়েই তারা এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

দেখা গেছে, তৃণমূলের কোনো নেতা গ্রেপ্তার হলেই পরবর্তী নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। চলমান একদফার আন্দোলনকে আরও বেগবান করে কৌশলে সাফল্য পেতে চায় তারা। অবশ্য গ্রেপ্তার ও মামলার আতঙ্কের মাঝে আগামী দিনের কর্মসূচি পালনে সংশয়ের কথাও জানিয়েছেন তৃণমূল বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মী। তারা বলছেন, গণহারে গ্রেপ্তার ও মামলার ভয়ে কর্মীরা দিশেহারা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ এলেও স্থানীয় পর্যায়ে তা সমন্বয় করতে বেগ পেতে হচ্ছে। কেননা দলীয় কর্মসূচিতে একসময় মুখর থাকা নেতাদের অনেকেই চলমান সংকটে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয় থাকার চেষ্টা করছেন।

ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, জামালপুরসহ কয়েকটি জেলা ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক জানান, পুলিশের মিথ্যা মামলার কারণে সাধারণত বাড়িতে থাকতে পারছে না। পুলিশ প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও গ্রেপ্তার করছে। গ্রেপ্তার এড়াতে নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দাবি, ২৮ অক্টোবরের পর সারা দেশে গণহারে গ্রেপ্তার চলছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলা না থাকলেও বিএনপির নেতাকর্মীদের ধরে পরে মামলা দিয়ে বা পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও মৃত ও কারাবন্দি ব্যক্তির নামেও মামলা দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় সব এলাকায় বিএনপির দলীয় কার্যালয় বন্ধ রাখা হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক নেতাকর্মী আত্মীয় বা পরিচিতদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।

পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নেতাকর্মীদের ধরতে গিয়ে না পেলে তাদের স্বজনদের হুমকি দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আসামিকে না পেলে বৃদ্ধ বাবা, ভাই এমনকি শ্বশুরকেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে দলের হাইকমান্ড মনে করছে, গ্রেপ্তার-ধরপাকড় আর মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের ঘরছাড়া করে যারা বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার কথা ভাবছে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল কালবেলাকে বলেন, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেওয়ার পরও সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার প্রমাণ করে এই সরকারের উদ্দেশ্য ভিন্ন। দেশের ৯৫ শতাংশ জনমত বিএনপির পক্ষে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘসহ গোটা বিশ্ব বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আহ্বান জানাচ্ছে।

কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যে মনে হয় তিনি আবারও একতরফা পাতানো নির্বাচন আয়োজন করতে চান। এক্ষেত্রে তার অনুগত পুলিশ-প্রশাসন বিরোধী দল-মত উচ্ছেদ করতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা পুরোনো কায়দায় নতুন কোনো ফর্মুলায় ভোট ডাকাতির পরিকল্পনা করছে। এত কিছুর পরও সরকারের কোনো ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না।বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন কালবেলাকে বলেন, হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার করে আমাদের দমানো যাবে না। আমরা বসে থাকব না। সরকারের পতন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব এবং সফল হবো ইনশাআল্লাহ।

নোয়াখালী জেলা বিএনপির উপদেষ্টা প্রকৌশলী আমিরুল মোমিন বাবলু বলেন, যত নির্যাতন-নিপীড়ন আসুক বিএনপির নেতৃত্বের কোনো সংকট হবে না। আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সরকারের রোষানলের শিকার হয়ে বিদেশে রয়েছেন। তার নেতৃত্বেই চলছে বিএনপি। তার নির্দেশে বিএনপির তৃণমূলের প্রত্যেক কর্মী নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। দলের প্রায় সব নেতাকর্মী এখন ঐক্যবদ্ধ।বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার আবারও একতরফা সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে চক্রান্ত শুরু করেছে। তবে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায়ে সংকল্পবদ্ধ। অচিরেই এই অবৈধ সরকারের পতন হবে। বিএনপির নেতৃত্বকে দুর্বল করা যাবে না। কারাগারের বাইরে থাকা বিএনপির সর্বশেষ ব্যক্তিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে।

এদিকে কর্মীশূন্য হয়ে পড়েছে ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। সেখানে প্রধান ফটকে এখনো তালা ঝুলছে। গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ও বন্ধ। বর্তমানে দলের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানানোর দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব (দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত) রুহুল কবির রিজভী। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে দলের সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছেন। গতকাল সোমবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সারা দেশে নেতাকর্মীদের ধরপাকড় ও মামলার চিত্র তিনি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় ৯৯৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। মোট মামলা হয়েছে ১০টি। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৫৯ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে মামলা হয়েছে ১৩২টির বেশি এবং মোট আসামি ৪০ হাজার ৬১৫ জন। মোট আহত হয়েছে প্রায় ৬ হাজার এবং এক সাংবাদিকসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের এভাবে ধরপাকড় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য অন্তরায় বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম সেলিম। তিনি কালবেলাকে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ থাকবে না। উত্তর কোরিয়ার মতো নির্বাচন হতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হলে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকতে হবে। তবে চলমান পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবিলায় সংলাপের সম্ভাবনা নেই বলে তিনি মনে করেন।সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বিভিন্ন দল ও জোটকে নিয়ে বিএনপি গত ১২ জুলাই যুগপৎভাবে আন্দোলন শুরু করে। এরপর টানা তিন মাস ঢাকাসহ সারা দেশে রোড মার্চ, পদযাত্রা, গণমিছিল, কালোপতাকা মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে।

গত ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ করে পরদিন ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি করে বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় আবারও মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেদিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। তবে সেদিন রাজধানীতে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নয়াপল্টনসহ কয়েকটি এলাকা। হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তারপর থেকে একে একে গ্রেপ্তার হয় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শীর্ষস্থানীয় নেতা। সর্বশেষ গত দুদিনে আটক করা হয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্সকে।

%d bloggers like this: