জাতীয়

অনিয়ম-দুর্নীতি ব্রহ্মপুত্রের বালু লোপাটের তদন্তেও

পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে ড্রেজার দিয়ে তোলা প্রায় ২১ কোটি ঘনফুট বালু লোপাটের তদন্ত প্রতিবেদনের প্রতি পরতে পরতে উঠে এসেছে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। প্রতি ঘনফুট বালু আড়াই টাকা হিসাবে সরকারের ক্ষতি হয়েছে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি। বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ২১ লাখ ২৮ হাজার টাকা।

২০১৮ সালে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা নদীর নাব্য উন্নয়ন এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্পের কাজ শুরু করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্র নদের বালু উত্তোলন করা হয়। গত ৯ জুন কালবেলায় ‘ব্রহ্মপুত্রের ২৩৩ কোটি টাকা বালু লোপাট’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সদর, সহকারী কমিশনার (ভূমি) সদর ও নির্বাহী প্রকৌশলী বিআইডব্লিউটিএ।

কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রায় সাড়ে তিন মাস পর জেলার সাত উপজেলার মধ্যে মাত্র দুই উপজেলার তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার তদন্ত প্রতিবেদনে বালু লোপাটের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। বাকি জেলাগুলোর তদন্ত কাজ কবে শেষ হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না।তবে তদন্তে প্রকৃত দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা স্পষ্ট হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রয়োজনীয় নথি না থাকায় ব্রহ্মপুত্রের বালু লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করার সম্ভব হবে না। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সদর ও গৌরীপুর উপজেলা বাদে বাকি পাঁচ উপজেলার বালু লোপাটের তদন্ত করতে গঠিত কমিটি অপারগতা প্রকাশ করেছে।

তাই নিজ নিজ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের বালু লোপাটের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছে মূল কমিটি। যদিও এই ছয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার জিম্মায় বালুগুলো রাখা হয়েছিল। তাই তাদের নেতৃত্বে তদন্তে বালু লোপাটের প্রকৃত চিত্র কতটুকু উঠে আসবে, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে বালু উত্তোলন সংক্রান্ত ফাইলের গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব হয়ে গেছে। এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পরই নথি গায়েব হয়। মোট বালুর পরিমাণ, ইজারাকৃত বালু, আর্থিক হিসাব, যেসব প্রতিষ্ঠানকে বালু দেওয়া হয়েছে সেগুলোর তালিকাসহ নথির মূল অংশের কাগজপত্র ছেঁড়া পাওয়া গেছে। এ কারণে বালু লোপাটের প্রকৃত চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয় বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, এ অপকর্মের সঙ্গে সাবেক একজন জেলা প্রশাসক জড়িত। তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বে না থাকলেও তার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে দিয়ে নথি ছিড়ে ফেলেছেন।ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থের বিনিময়ে বালু দেওয়া হয়েছে। অথচ বিনা টাকায় বালু দেওয়ার কথা বলা হয়েছে কাগজপত্রে। বিভিন্ন ভাউচারে যে পরিমাণ বালু দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর কয়েকগুণ বেশি দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ময়মনসিংহ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে থাকা এ সংক্রান্ত পুরো নথি পাওয়া যায়নি। অনেক কাগজ ছেঁড়া পাওয়া গেছে।

তাই মূল কাগজের সঙ্গে মিলিয়ে তদন্ত করা কঠিন। এ কারণে ঘটনার প্রকৃত চিত্র তদন্তে হয়তো উঠে আসবে না। তবুও আমরা সদর উপজেলার তদন্ত শেষ করে তা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় তদন্তে বেশি সময় লেগেছে। প্রতিবেদনে আমরা চেষ্টা করেছি সার্বিক চিত্র তুলে ধরার। এর মধ্যে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমাদের পক্ষে সব উপজেলার তদন্ত কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। এজন্য নিজ নিজ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।সদর উপজেলার তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি এসেছে কালবেলার হাতে। এতে ৪৭টি পয়েন্টে মোট ২০ কোটি ৮২ লাখ ৯৯ হাজার ১৭০ ঘনফুট বালুর হিসাব মিলেছে। গত বছরের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত উত্তোলন করা বালু ও মাটির পরিমাণ ১৫ কোটি ২৮ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৯ ঘনফুট।

চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ফের উত্তোলিত বালুর পরিমাণ ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৫৪ হাজার ৫৯৮ ঘনফুট। এর মধ্যে বালু পরিমাপ করা হয়নি এমন স্থানের সংখ্যা ৫টি। এসব স্থানের বালুর কী অবস্থা, তা জানতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গত বছরের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আটটি স্থানের জেলা বালুমহাল মাটি ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইজারাকৃত বালুর পরিমাণ ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯১ ঘনফুট। তবে কত টাকায় এই পরিমাণ বালু ইজারা হয়েছে, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।১১টি স্থানের ৮ কোটি ৫২ লাখ ৯ হাজার ১১৭ ঘনফুট বালুর দরপত্র আহ্বানের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যদিও এই বালু উত্তোলন করা হয়েছে দেড় বছরের বেশি সময় আগে। দীর্ঘ সময় পর বালু বিক্রির জন্য দরপত্র কেন আহ্বান করা হয়নি, এর সদুত্তর কেউ দিতে পারেনি।

পাঁচটি স্থানের ২ কোটি ৩০ লাখ ৩ হাজার ১২০ ঘনফুট বালু নিয়ে স্থানীয় লোকজন বসতভিটা করেছে। প্রকৃত অর্থে এই বালু লোপাট হয়েছে বলে ধারণা অনেকের।এর বাইরে ১২ স্থানের সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৫ হাজার ৫৩৭ ঘনফুট বালু। বেশিরভাগ বালু দেওয়া হয়েছে জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে। এতে মোটা অঙ্কের রাজস্ব গচ্চা গেছে। এ ব্যাপারে প্রতিবেদনে কাউকে দোষারোপ করা না হলেও প্রকৃত অর্থে এর দায় জেলা প্রশাসনের বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বালু সরবরাহ করে তা বিনামূল্যে দেখানো হয়েছে।

ইজারায় বালু ও মাটি বিক্রিতেও মিলেছে অনিয়মের স্পষ্ট ছাপ। ছয়টি পয়েন্টে বিক্রি হয়েছে ৩ কোটি ৯২ লাখ ৯ হাজার ঘনফুট বালু। এর মধ্যে ১ টাকা ৪২ পয়সা দরে বিক্রি হয়েছে ১৮ লাখ ৪৬ হাজার ঘনফুট। বাকি ২ কোটি ৯০ লাখ ৮৩ হাজার ঘনফুট বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭৭ পয়সা দরে। দামের বিশাল হেরফের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়রা জানান, সাধারণত দুই থেকে আড়াই টাকা প্রতি ঘনফুট বালু ইজারায় বিক্রি হয়। খুচরা বাজারে যা চার টাকার বেশি। এই হিসাবে প্রায় চার কোটি ঘনফুট বালু বিক্রিতে পুকুরচুরি হয়েছে। দরপত্রে প্রতি ঘনফুট বালুর দাম দুই টাকার বেশি দাম পড়লেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কম দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র।

প্রকল্প কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী ১১৩ কোটি ঘনফুটের বেশি বালু তোলা হয়েছে। যার অর্থমূল্য ২৫০ কোটি টাকার বেশি। অথচ বালু বিক্রি করে মাত্র ১৭ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে জেলা প্রশাসন।অভিযোগ ওঠে, জেলা প্রশাসন, বিআইডব্লিউটিএ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) অবহেলায় বেশিরভাগ বালু লুটপাট হয়ে গেছে। রাতের আঁধারে বালু বিক্রি করেছে অসাধু মাটি ব্যবসায়ী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এর সঙ্গে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ ঘটনায় দায় নিতে চায় না কেউ। নানা কথা বলে বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে ময়মনসিংহের বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোহসিন মিয়া কালবেলাকে বলেন, সদর উপজেলার তদন্তে কিছু কিছু জায়গায় মাটি খোয়া যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ-সংক্রান্ত ফাইলে বালু ও মাটি বিক্রির নথি পাওয়া যায়নি। তাই বালু লোপাটের বিষয়টি তদন্তে খুব স্পষ্টভাবে তুলে আনা সম্ভব হয়নি।

আরও খবর

Sponsered content