জাতীয়

পদোন্নতির লড়াই ভোটের আগে পুলিশে

যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি মিলছে না বলে নানা স্তরের পুলিশের মধ্যে দাবি উঠেছে। এতে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। এই পদোন্নতির জন্য রীতিমতো ‘লড়াই’ শুরু হয়েছে। পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা ব্যাচ ধরে পুলিশপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করছেন, তাদের দাবির কথা জানাচ্ছেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও প্রয়োজনীয় পদোন্নতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালি চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা চাচ্ছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই তাদের পদোন্নতির দাবি পূরণ করে নিতে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পুলিশ সদর দপ্তরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক মাসে অতিরিক্ত আইজিপির দুটি পদসহ ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি এবং পুলিশ সুপার পদে মোট ৩৪২টি পদ সৃষ্টির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। তবে এতেও ক্ষোভ ও হতাশা কমেনি কর্মকর্তাদের মধ্যে। যদিও এখন পর্যন্ত ওই সব পদে পদোন্নতি মেলেনি। এর মধ্যেই সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০ থানার ওসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাদের পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে দাবি জানিয়ে এসেছেন। এর আগে তারা আইজিপির সঙ্গেও দেখা করেন। এ ছাড়া সম্প্রতি বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ৩৫ ও ৩৬ ব্যাচের সহকারী কমিশনার পদের কর্মকর্তারা আইজিপির সঙ্গে দেখা করে তাদের পদোন্নতির জোর দাবি জানান।

অবশ্য অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) কামরুল আহসান গতকাল মঙ্গলবার কালবেলাকে বলেন, এই পদোন্নতি চাওয়ার সঙ্গে ভোটের কোনো সম্পর্ক নেই। এই পদোন্নতি প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন পদে পদোন্নতির জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছি। প্রস্তাবগুলো মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে। এগুলো হয়ে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, পদ শূন্য না থাকায় বাস্তবতার নিরিখে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ‘সংখ্যাতিরিক্ত পদ’ তৈরি করে প্রায় ৫২৯ শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে।

এই প্রস্তাবের মধ্যে ১৫ অতিরিক্ত আইজি (গ্রেড-১), ৩৫ অতিরিক্ত আইজি (গ্রেড-২), ১৪০ ডিআইজি, ১৫০ অতিরিক্ত ডিআইজি ও ১৯০ এসপির পদোন্নতির প্রস্তাব ছিল। যাচাই শেষে সম্প্রতি অতিরিক্ত ডিআইজির ১৪০ পদ এবং এসপির ১৫০ পদসহ মোট ২৯০টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত আইজিপির দুটি পদ এবং এবং ৫০টি ডিআইজি পদ সৃষ্টিতে সম্মতি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি করোনাকালসহ নানা সময়ে পুলিশ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালন করছে। বিসিএস ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়ে ১০ বছর চাকরির পর এসপি পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা; কিন্তু চাকরিকাল ১০ বছরের বেশি সময় পার হলেও পদ শূন্য না থাকায় পদোন্নতি হচ্ছে না। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরও পদোন্নতি না হওয়ায় কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। এই হতাশা থেকে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। সামনে নানা রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশকেই কাজ করতে হবে। হতাশা বা ক্ষোভ থাকলে দায়িত্ব পালনেও সমস্যা তৈরি হয়।

এমন পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই তারা নবসৃষ্ট পদগুলোতে তাদের কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতির পাশাপাশি আরও পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়া হবে বলে আশা করছেন।পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির মাধ্যমে তাদের হতাশা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবের বিপরীতে যে পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অপ্রতুল। এজন্য অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজি পদ বাড়াতে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাবনার আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।

পদ না থাকলেও নির্বাচনের আগে পদোন্নতির দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া কালবেলাকে বলেন, পদোন্নতি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। পদ খালি হলে যারা যোগ্য, জনস্বার্থে তাদের পদোন্নতি দেওয়ার নিয়ম। তবে বর্তমানে তা অনুপস্থিত।তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এখন সব পেশাজীবীই যতটা দাবি আদায় করে নিতে পারে, সেই চেষ্টা করবে। কারণ সরকারও এখন চাইবে না তাদের কাউকে নারাজ করতে। তাই খুশি করার জন্য পদ নাই, তবুও হয়তো পদোন্নতি দেবে। এসব ভেবেই পুলিশসহ নানা পেশাজীবীরা দেনদরবার করছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, পদোন্নতির দাবিতে পুলিশের ৩৫ ও ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তারা আইজিপির সঙ্গে দেখা করেন ২৬ সেপ্টেম্বর। নির্ধারিত সময়েও পদোন্নতি না হওয়ায় সেখানে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সেইসঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দ্রুত পদোন্নতি নিশ্চিত করার জন্য পুলিশপ্রধানকে অনুরোধ জানান। পদোন্নতির দাবিতে সেখানে হট্টগোলও হয়।৩৫ ব্যাচের ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন সহকারী কমিশনার কালবেলাকে বলেন, তাদের চাকরিকাল অনুযায়ী এখন ষষ্ঠ গ্রেডে (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল। প্রশাসন ও আনসার ক্যাডারসহ আরও কয়েকটি ক্যাডারের সদস্যরা এরই মধ্যে নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পেলেও তারা বঞ্চিত। এতে তাদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি ক্ষোভও সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কথা তারা পুলিশপ্রধানকে জানিয়েছেন।

৩৬ বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাদের সঙ্গে চাকরিতে যোগ দেওয়া প্রশাসন ক্যাডার ও আনসার ক্যাডারসহ বেশ কিছু ক্যাডার সার্ভিসের লোকজন এরই মধ্যে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পেয়েছেন। তারা এখনো পদোন্নতি না পাওয়ায় হতাশ হচ্ছেন। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে এই পদোন্নতি দাবি করেছেন।পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ৩৪তম বিসিএস পুলিশের অন্তত ৪০০ জন, ৩৫তম ব্যাচের ১১৫ জন এবং ৩৬তম ব্যাচের ১১৬ জন পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত সব মানদণ্ড পূরণ করে পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন।বিসিএস পুলিশ ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ফোর্সের সংখ্যা বাড়লেও ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদ সৃষ্টি হয়নি।

এজন্য যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকলেও পদোন্নতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হয়। কিন্তু পুলিশকেই সব ধরনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করতে হয়।সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক কালবেলাকে বলেন, চাকরিতে পদোন্নতি একজন কর্মকর্তার কাজের স্পৃহা ও দায়িত্ববোধ আরও বাড়িয়ে দেয়। যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকার পরও সময়মতো তা না পেলে এর প্রভাব কিছুটা কাজে পড়বে। কিন্তু সবাই তো আর পদোন্নতি পাবে না। যারা যোগ্য, কর্মক্ষেত্রে যাদের প্রতিবেদন ভালো, তারাই পদোন্নতি পাবে।