5 December 2024 , 1:55:24 প্রিন্ট সংস্করণ
তিন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব, আনছার, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ অন্তত ৬০ জনের একটি সজ্জিত দল যাচ্ছিলেন অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযানে। তবে তাঁরা একটি ইটভাটায়ও পৌছাতে পারেননি। তাঁদেরকেই পথেই আটকে দিয়েছেন অবৈধ ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা। পথে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর সাদা কাগজে শুধু ভাটা মালিকদের মুচলেকা নিয়ে কোনমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে প্রশাসনের এই সজ্জিত দলটি। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চরসাদিপুর ইউনিয়নের ভোমররার মোড়ে গতকাল বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সকাল ১১ টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত অবরোধেরর পর মুচলেকা নেওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখানে কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী ও পাবনা সদর উপজেলা প্রশাসন এবং কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথ অভিযান চালাতে গিয়ে এমন বাঁধার মুখে ফিরে আসেন।
ফিরে আসা কর্মকর্তরা হলেন-কুষ্টিয়া সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিফাতুল ইসলাম, কুমারখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আমিরুল আরাফাত, পাবনা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুরাদ হোসেন ও কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হাবিবুল বাসার। প্রশাসনের কর্তাদের ভাষ্য, পদ্মা নদীর কুলঘেঁষে চরসাদিপুর একটি দুর্গম চরাঞ্চল এলাকা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। নৌকা একমাত্র চলাচলের যানবাহন। সেখানে অন্তত ৩০ টির অধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। শত চেষ্টার পরও মালিক-শ্রমিকদের বাঁধার মুখে অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন প্রয়োগ না করেও ফিরে এসেছেন তাঁরা। আগামী বছর মালিকরা অবৈধ ভাটা চালাবেন না, এই মর্মে শুধু মুচলেকা নিয়ে ফিরে আসা হয়েছে।
তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, পদ্মার কারণে চরসাদিপুর এলাকায় প্রশাসনের নজরদারি নেই। ফলে কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে অংসখ্য অবৈধ ভাটা। ভাটায় পুড়ানো হচ্ছে নদী ও ফসলি জমির মাটি ও কাঠ। ভেঙে পড়ছে গ্রামীণ সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভেঙে পড়েছে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সেজন্য অবৈধ ভাটা মালিকদের বাঁধার মুখে ফিরে গেছেন প্রশাসনের কর্তারা। জানা গেছে, পদ্মা নদীর কুলঘেঁষে ২২ বর্গমাইল আয়তন নিয়ে গঠিত কুমারখালীর চরসাদীপুর ইউনিয়ন। এখানে প্রায় ২৩ হাজার মানুষের বসবাস। তিন ও দুই ফসলি কৃষি জমিতে আইন অমাণ্য করে গড়ে ওঠেছে প্রায় ৩৩ টি অবৈধ ইটভাটা। যার মধ্যে অন্তত ১৯টিতে ব্যবহার হচ্ছে টিনের ড্রাম চিমনি। এছাড়াও ইউনিয়ন ঘেঁষে কুষ্টিয়া সদর ও পাবনা অংশজুড়ে রয়েছে আরো অন্তত ৭ টি ভাটা। যার সব গুলোই অবৈধ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রস্থের পদ্মা নদীর সাড়ে তিন কিলোমিটারে চর জেগেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সদস্যরা নৌকা যোগে ও পাঁয়ে হেঁটে নদীপাড় হন। পরে তাঁরা ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল যোগে চরসাদিপুর ইউনিয়নরের ভোমররার মোড় এলাকায় পৌছালে নারায়েতকবির দিয়ে ঘোষণা দিয়ে ভাটা মালিক, শ্রমিকসহ কয়েক শত লোক তাঁদের পথ আটকে দেন। সেখানে প্রায় আড়াই ঘণ্টা প্রশাসনের সঙ্গে মালিক-শ্রমিকদের তর্কবিতর্ক হয়। অবরোধকারীদের পক্ষ থেকে সাদীপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম আজম বলেন, হাজার হাজার শ্রমিক এখানকার ইটভাটাগুলোতে কাজ করে সংসার চালায়। তারা ইতিমধ্যে ভাটা মালিকের থেকে মোটা অংকের দাদন (অগ্রিম টাকা) নিয়েছে। এখন ভাটা বন্ধ হলে তারা কি করে খাবে, কীভাবে দাদন (অগ্রিম টাকা) পরিশোধ করবে? যদি বন্ধ করতেই হয় তবে ইটভাটা শুরুর আগেই মাইকে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করতো। তাহলে শ্রমিকরা এতো এতো টাকা অগ্রিম নিতো না। এখন এগুলো (ইটভাটা) বন্ধ করা অন্যায়।
শ্রমিকদের পক্ষে সাদীপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল মজিদ বলেন, জেলা প্রশাসকের কাছে আমাদের আবেদন লেবারদের স্বার্থ চিন্তা করে এ বছরের মতো ইটভাটাগুলো চলতে দিক। কারণ ইতিমধ্যে শত শত কোটি টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে, লেবাররা অগ্রিম টাকা নিয়েছে। এখন ইটভাটা বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে লেবাররা। আপনারা শুনলেন লেবাররা বলতেছে ভাটা বন্ধ হলে না খেয়ে মরবে তারা। এখন হুট করে তারা কোন কাজে যাবে। অল্প কিছু লোক না, হাজার হাজার মানুষ। খুলনা ও সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকেও এসেছে। এসব কিছু বিবেচনায় এ বছরের মতো ইটভাটা চলতে দেওয়া হোক। আগামী বছর না চলতে দিলে আগে জানিয়ে দেবে, লেবাররা ভিন্ন পেশা খুঁজে নেবে।
একপর্যায়ে মুচলেকা নিয়ে ফিরে আসেন কর্মকর্তারা। এসময় অবৈধ এবিসি ভাটা মালিক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ব্যাংক লোন ও ধারদেনা করে অবৈধভাবে ভাটা চালাচ্ছি আমরা। অন্তত ১৯ টি ড্রাম চিমনিসহ ৪০ টি অবৈধ ভাটা রয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করে। সেজন্য তাদের জীবিকার কথা চিন্তা সম্মিলিত ভাবে অভিযানে বাঁধা দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর আর অবৈধ ভাটা চালাবো না, এই মর্মে মুচলেকা দিয়েছি। এসব তথ্য নিশ্চিত করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কুমারখালী সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিরুল আরাফাত বলেন, দুর্গোম চরসাদিপুর এলাকায় ৩০টির অধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে অবৈধ ভাটায় অভিযান চালাতে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব, আনছার, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্তত ৬০ জনের একটি দল যাচ্ছিলেন।
তবে ভাটা মালিক ও শ্রমিকরা পথেই অভিযান আটকে দিয়েছেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েও ভাটায় পৌছানো যায়নি। সেখানে জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর ভাষ্য, আগামী বছর আর অবৈধ ভাটা চলবে না, এই মর্মে ভাটা মালিকদের মুচলেকা নেওয়া হয়েছে। সরকারি কাজে বাঁধা প্রধানকারীদের তালিকা করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি বলেন, পরবর্তীতে আরো গুছিয়ে সুসজ্জিত ভাবে চরসাদিপুরে অভিযান চালানো হবে। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, অভিযানের ফিরতি মেসেজ এখনও তাকে জানানো হয়নি। জেনে পরে বিস্তারিত বলবেন তিনি।