বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

যেভাবে রসায়নবিদরা অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হন

প্রকৃতির সবখানেই রসায়ন। আমাদের দেহের কথাই বলি বা চারপাশ ঘিরে থাকা বাতাস, ফুলের ঘ্রাণ—সবকিছুতেই আছে রসায়ন। এর মূল কথাগুলো কি সহজে জানা সম্ভব? মহাবিশ্বের মতো বিপুল রসায়নের জগতের মূল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় তুলে আনার সেই চেষ্টা করেছেন লেভ ভ্লাসভ ও দ্‌মিত্রিই ত্রিফোনভ। বাংলায় অনূদিত হয়েছে সরাসরি রুশ থেকে, রসায়নের শত গল্প নামে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কোয় ছিল প্রগতি প্রকাশন। আপনারা সম্ভবত হার্বাট ওয়েলসের (এইচ জি ওয়েলস) চমৎকার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী দ্য ওয়্যার অব দ্য ওয়ার্ল্ড পড়েছেন। মঙ্গলগ্রহের আগন্তুকদের পৃথিবী আক্রমণ নিয়েই ঘটনাটি।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, মঙ্গলগ্রহের শেষ অধিবাসীটি নিহত হওয়ার পর পৃথিবীতে যখন শান্তি এল, তখনই সদ্যশঙ্কামুক্ত বিজ্ঞানীরা প্রতিবেশী গ্রহবাসীদের আনা জিনিসপত্রের অবশেষটুকু দ্রুত পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। সবকিছুর মধ্যে পৃথিবীর জীবন ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত এক ধরনের কালো গুড়া সম্পর্কে তাঁরা বিশেষ কৌতূহলী হন। এ নিয়ে তাঁদের অনেক পরীক্ষা মারাত্মক বিস্ফোরণে ব্যর্থ হয়। শেষে জানা গেল দুর্ভাগা জিনিসটি নিষ্ক্রিয় আর্গন গ্যাসের যৌগ এবং এতে পৃথিবীর অজ্ঞাত কয়েকটি মৌল মিশ্রিত। যাহোক, লেখক বইটির শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর সময়ই কিন্তু রাসায়নবিদরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, আর্গনের পক্ষে কোনো অবস্থায় সমাবদ্ধ হওয়া অসম্ভব।

তাদের সিদ্ধান্ত ছিল বহু বাস্তব পরীক্ষার ফলশ্রুতি। আর্গনকে ইনার্ট (নিষ্ক্রিয়) গ্যাস বলা হয়। নিষ্ক্রিয়তার গ্রিক অর্থ ‘ইনার্ট’ থেকেই শব্দটির উদ্ভব। রাসায়নিক পদার্থের পুরো একটি দঙ্গল এই কুঁড়েদের দলভুক্ত আর এতে আছে আর্গন সহ হিলিয়াম, নিয়ন, ক্রিপ্টন, জেনন ও রেডন। পর্যায়বৃত্তে এরা শূন্য দলের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, এই মৌলগুলোর যোজ্যতা শূন্য মানের সমান। উক্ত নিষ্ক্রিয় গ্যাসদের পরমাণুরা ইলেকট্রন দিতে বা নিতে সম্পূর্ণ অপারগ। তাদের সক্রিয় করার জন্য রসায়নবিদরা কী না করেছেন! বিজ্ঞানীরা তাদের এমন তাপমাত্রায়ও তাতিয়েছেন, যেখানে সবচেয়ে দুর্গল ধাতুও টগবগ করে, তাঁরা তাদের কঠিন না হওয়া অবধি ঠান্ডা করেছেন, তাদের মধ্যে প্রচন্ড শক্তির বিদ্যুৎ প্রবাহিত করেছেন এবং তাদের আক্রমণ করার জন্য সাঙ্ঘাতিক সব রাসায়নিক এজেন্ট নিয়োগ করেছেন। কিন্তু হায়, সবই বৃথা!

যেখানে অন্য যেকোনো পদার্থ অনেক আগেই পোষ মেনে রাসায়নিক সমাবন্ধনে আত্মসর্মপণ করত, সেখানে নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর ঠাঁই অনড় রইল। মনে হলো, তারা পরীক্ষকদের বলছে, ‘বৃথাই সময় নষ্ট করছ হে, কোনো বিক্রিয়ায় জড়াতে আমরা বিন্দুমাত্রও ইচ্ছা নাই। আমরা এ সবের ঊর্ধ্বে!’ একগুঁয়েমির জন্যই তাদের ভাগ্যে জুটল আরও একটি খেতাব: ‘অভিজাত গ্যাসবর্গ’। পৃথিবীতে হিলিয়ামের অস্তিত্বের আবিষ্কারক রামজে সঙ্গতভাবেই গর্ব করতে পারতেন। তিনি আমাদের একটি সত্যিকার নতুন রাসায়নিক পদার্থ উপহার দিয়েছিলেন।

একটি রাসায়নিক পদার্থ! হিলিয়ামকে পর্যায়বৃত্ত সারণীর অন্যান্য পদার্থের মতো আচরণ শিক্ষা দেওয়ার জন্য অর্থাৎ হাইড্রোজেন, অক্সিজেন অথবা গন্ধকের সঙ্গে মেশার জন্য স্যার উইলিয়াম রামজে বেশকিছু মূল্য দিতেও রাজী ছিলেন। এমনটি ঘটলে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকরা মঞ্চ থেকে হিলিয়ামের অক্সাইড আর লবণ সম্পর্কেও কিছু বলতে পারতেন। কিন্তু নিষ্ক্রিয় গ্যাসদলের পয়লা নম্বর সভ্য এই হিলিয়াম তাঁদের নিরাশ করল। বিগত শতাব্দীর শেষপাদে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদ্বয়—রামজে ও র‍্যালে নিয়ন, আর্গন, ক্রিপ্টন ও জেনন আবিষ্কার করেন। শেষে পাওয়া গেল এই রাসায়নিক কুঁড়েদলের ঘনিষ্ঠ রেডনকে। এরা সকলেই স্বকীয় পারমাণবিক ভরবিশিষ্ট রাসায়নিক মৌল। কিন্তু সত্যি বলতে কী, এদের উপসর্গ হিসেবে কেউই ‘রাসায়নিক’ বিশেষণটি এদের নামের সঙ্গে যোগ করে বলবে না: ‘মৌল আর্গন’।