ভিন্ন স্বাদের খবর

এবার ভালো কাজের বিনিময়ে খাবার মিলে যেখানে

তপ্ত দুপুর। মাথার উপরে খাঁ খাঁ রোদ। শরীরে নেই জামা-জুতা। চোখে-মুখে ক্ষুধার ছাপ। খাবারের অপেক্ষায় শিশু মেহেদি হাসান। কোলে দেড় বছরের ভাই আলিফ। তার শরীরেও নেই পোশাক। ছোট্ট ভাইটি মলিন মুখে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। একটি ভালো কাজের বিনিময়ে কাওরান বাজারে ‘ভালো কাজের হোটেলে’ খেতে এসেছে তারা। ফুটপাথে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা তাদের।কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর মিললো খাবার। খাবার পেতেই তাদের মুখ হাসিতে ভরে উঠে। খুব তৃপ্তি নিয়ে ফুটপাথে পাশাপাশি বসে খাবার খাচ্ছিলো তারা।

মেহেদি হাসান জানায়, এখানে একটি ভালো কাজ করে খেতে এসেছি। হাতিরপুল সিগন্যালে একজন বয়স্ক লোককে রাস্তা পারাপার করে দিয়েছি। পেপারস গলিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকি। আগেও অনেক বার এখানে খেতে এসেছি।মেহেদির মতো অনেকেই এসেছে ‘ভালো কাজের হোটেলে’। ব্যতিক্রমী চিন্তা থেকেই এর যাত্রা শুরু। এই হোটেলে খেতে হলে গুনতে হবে না কোনো টাকা। এক বেলা খাবার খেতে একটি ভালো কাজ করলেই চলবে। যদি কোনো ভালো কাজ নাও করে থাকেন তাহলে সেই সত্য কথাটা বললেও তার জন্য থাকে খাবার। খালি মুখে ফিরে যেতে হয় না এ হোটেল থেকে। দিন আনা দিন খাওয়া দুস্থ, অসহায় ও নিম্ন আয়ের মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতেই এ হোটেলের যাত্রা শুরু।

একদল তরুণ ভালো কাজকে উৎসাহিত করতে এই ব্যতিক্রমী হোটেলটি শুরু করেছিলেন। প্রতিদিনই তারা একটি ভালো কাজের বিনিময়ে খাবার দেন। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত এবং সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চলে এর কার্যক্রম। কাওরান বাজার, সাত রাস্তা মোড়, বনানী ও কড়াইল বস্তির শাখা, মিরপুর-২, কালশি। এবং রাতে কমলাপুর, খিলগাঁও, রবীন্দ্র সরোবর, মোহাম্মদপুরে। চেয়ার-টেবিল দিয়ে সুসজ্জিত না থাকলেও খোলা আকাশের নিচে ফুটপাথে সারিবদ্ধ হয়ে বসে সবাই তৃপ্তি নিয়ে খান এই খাবার।সরজমিন কাওরান বাজার, সাত রাস্তাসহ কয়েকটি স্পটে গিয়ে দেখা যায়, ফুটপাথঘেঁষা দেয়ালে লাল বর্ণে বড় করে লেখা ‘ভালো কাজের হোটেল’।

একজনের পাশে এসে আরেকজন বসছেন। দীর্ঘ হচ্ছে এই লাইন। এভাবে ফুটপাথে দীর্ঘ সারি। খাবার পাবার অপেক্ষা তাদের। কেউ কুলি, রিকশাচালক, ভবঘুরে আর পথচারীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ। সময় হওয়ার আগেই আসতে থাকেন তারা। দুপুর বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পিকআপে করে খাবার নিয়ে এলেন স্বেচ্ছাসেবকরা। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অতিথিদের মুখে তখন হাসি। খাবারের হাঁড়িগুলো নামিয়ে রাখলেন ফুটপাথে। এরপর বুফে সিস্টেমে করে খাবারের আয়োজন। খিচুড়ি, ডিম, সবজি ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে রেখে দিলেন। স্বেচ্ছাসেবক এক তরুণ একটি খাতায় লিখলেন তাদের নাম ও ভালো কাজের কথা। তারা কেউ বয়স্ক মানুষকে রাস্তা পার করে দিয়েছেন, কেউ রিকশায় বিনা ভাড়ায় এগিয়ে দিয়েছেন গন্তব্যে আবার কেউ রাস্তায় ফেলে থাকা ময়লা পরিষ্কার করেছেন।

কেউবা জানালেন তাদের কোনো ভালো কাজ না করার কথা। লাইনে দাঁড়িয়ে একজন একজন করে নাম লিখে পাশে রাখা প্লেট নিয়ে নিজেরাই খাবার তুলে নিয়ে খেতে বসছেন ফুটপাথে।মোহাম্মদপুর থেকে কাওরান বাজার শাখায় খেতে এসেছিলেন মো. মানিক মিয়া। পেশায় রিকশাচালক। মানিক মিয়া বললেন, ঢাকা উদ্যানে একজন বয়স্ক রিকশা চালককে ধাক্কা দিয়ে উঁচু রাস্তা থেকে নামিয়ে দিয়েছি। বিনিময়ে টাকা নেইনি। যেদিন ভালো কাজ করি ওইদিন আসি। রবিউল ইসলাম বলেন, সব সময় একটা ভালো কাজ করে এখানে খেতে আসি। আমি ভাঙ্গাড়ি টোকাই। আগে চেয়ে চেয়ে খেতাম মানুষের কাছ থেকে। আজ এক বয়স্ক মানুষকে রাস্তা পার করে দিয়েছি। এরপর দুপুরে এখানে খাবো।

কাওরান বাজারে মিন্তির কাজ করেন হাসমত আলী। তিনি কাজের সন্ধানে দুই বছর আগে ঢাকায় এসেছেন। ফুটপাথে থাকেন। রাত হলে নেমে পড়েন কাজে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তার তিনবেলার খাবার নিয়ে। হাসমত আলী বলেন, ঢাকায় যখন আসি তখন খাবার নিয়ে খুব হতাশ হতাম। তেমন কোনো কামাই-রোজগার ছিল না। হোটেলে খেলে অনেক টাকা খরচ হতো। কখনো না খেয়ে থাকি। এরপর এক বন্ধুর মাধ্যমে এই ভালো কাজের হোটেলের খবর পাই। এসে দেখি কোনো টাকা লাগে না; একটা ভালো কাজ করেই খেতে পারবো। তখন থেকে প্রতিদিন কোনো না কোনো ভালো কাজ করে এখানে খেতে আসি।

এ হোটেলের সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক রুবেল আহমেদ হিমেল বলেন, কাওরান বাজারের এই শাখাটি একটু অন্য শাখার চেয়ে ভিন্ন। এখানে বুফে সিস্টেমে অতিথিদের খাওয়ানো হয়। তারা নিজেরা খাবার নিয়ে খাচ্ছে প্লেটে করে। আর অন্যগুলোতে ফুটপাথে বসে লাইন ধরে বসে থাকে। সেখানে আমরা খাবার তুলে দেই। এখানে আসা এসব মানুষ বুফে কি এটাই চিনে না। আমরা চাই তারা একটু নিজেরা খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে আনন্দ পাক। আমাদের প্রত্যেকটি শাখাতেই একদিন ভাত, একদিন খিচুড়ি, সপ্তাহে দুইদিন গরুর মাংসের ব্যবস্থা করি। নয়টা হোটেলের মধ্যে দুইটা হোটেলে বুফে সিস্টেম। দুপুরে চলে কাওরান বাজার, সাতরাস্তা, বনানী, মিরপুর এবং কালসি।

আর বাসাবো, কমলাপুর, মোহাম্মদপুর ও ধানমণ্ডি- বাকি চারটা রাতে চলে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ১৫০-২০০ মানুষকে খাওয়ানো হয়। শুক্রবার বন্ধ থাকে এটা। যারা আসে তাদের ১০০ জনকে জিজ্ঞেস করলে বলবে ভালো কাজ করছি। ৫ জন বলবে আমি করিনি আর ৫ জন মিথ্যা বলবে। আমরা ওদেরকে বলে দেই সবাই সত্য বলবা; কারণ সত্য বলাও কিন্তু একটা ভালো কাজ। কেউ সত্য বললে তাকে ফিরিয়ে দেই না। এখানে রিকশাচালক, নিম্ন আয়ের মানুষ, ভাসমান মানুষ এসবই বেশি আসে। এসব মানুষেরা অনেকে নেশায় আসক্ত থাকে; তারা ক্ষুধার যন্ত্রণায় অনেক খারাপ কাজ করে। আমরা খাওয়াই এবং খাওয়ানোর পরে ব্রিফ করি এবং প্রত্যেক দিন সবাইকে একটা ভালো কাজ করার উৎসাহ দেই।

তাহলে খারাপ কাজ থেকে ওরা অনেকটা দূরে সরে থাকবে। আমাদের এখানে যারা খেতে আসে আসলে তাদের চেয়ে গরিব মানুষ আর হয় না। নয়টা শাখায় প্রায় ২৫০০ মানুষের খাবার ব্যবস্থা হয়। আমাদের ইচ্ছা একটি ক্ষুধামুক্ত দেশ করা।সিনিয়র স্বেচ্ছাসেবক জাকির হোসাইন বলেন, বর্তমানে আমাদের দশটি শাখা রয়েছে। এরমধ্যে নয়টি শাখা ঢাকাতে আর একটি চট্টগ্রামে। ঢাকার নয়টি শাখার পাঁচটি দিনের বেলায় চলে বাকি চারটি শাখা রাতে। শুরু থেকে গত কয়েক বছর নিম্ন আয়ের মানুষ খুব একটা বলতে ছিল না। বেশির ভাগ ভাসমান মানুষগুলো আসতো। তবে গত এক-দুই বছরে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো খাবার খেতে আসছে। দুইটি জিনিসের উপর ডিপেন্ড করে আমাদের ফান্ডটা। একটা হচ্ছে ডেইলি টিম মেম্বার আর পাশাপাশি কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ডোনারও রয়েছে। আমাদের বর্তমানে প্রায় ২৮০০ ডেইলি মেম্বার রয়েছে।

তারা দৈনিক দশ টাকার সদস্য। এই মেম্বারদের মধ্যে অনেক মেম্বারের প্রতি মাসে কারও না কারও সন্তানের জন্মদিন, বাবার মৃত্যুবার্ষিকী বা বিবাহবার্ষিকী থাকে। তারা অন্য ভাবে সেগুলো পালন না করে আমাদের এখানে খাওয়াচ্ছেন। প্রবাসীও অনেক ভাই আছেন। আমাদের শুরু থেকে ১১০ জন সদস্য ছিল।যখন থেকে ভালো কাজের হোটেল শুরু হয় তখন থেকে এটি আমরা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেই। যে কেউ চাইলে এখানে সদস্য হতে পারবে। যারা প্রতি মাসে অন্তত ৩০০ টাকা চাঁদা দিবে। কেউ কেউ আছে তারা ৩০০ টাকার চেয়েও অনেক বেশি দেন। দিনে খরচ পড়ে প্রায় ৯০ হাজার। এবং মাসে খরচ হয় ৩০ লাখের বেশি। সরকারিভাবে আমরা কোনো অনুদান পাই না। বছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বাৎসরিক একটা টাকা দেয়। আমাদের প্রত্যেকটি হোটেল ফুটপাথে।

ডিসি অফিস থেকে ঢাকার ওয়ারীতে একটা জমি পেয়েছি কিন্তু সেটি এখনো বুঝে পাইনি।ভালো কাজের হোটেলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মো. আরিফুর রহমান বলেন, ছোটবেলা থেকেই প্রতিদিন একটা ভালো কাজ করার চেষ্টা করতাম। এরপর একসময় মনে হলো এই ভালো কাজ শুধু নিজে করলে হবে না এটাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘সবুজ ছায়া’ নামের একটি নাটক দেখেছিলাম। সে নাটকে অভিনেতা জাহিদ হাসান প্রতিদিন ভালো কাজ করতেন। সেই ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ২০০৯ সালে আমি এবং আমার কিছু বন্ধু ‘ভালো কাজের হোটেল’ চালু করি। ২০১৯ সালের দিকে সপ্তাহে একদিন করে খাবার দিতাম।

এরপর ২০২০ যখন কোভিড আসলো তখন প্রতিদিন আমাদের এই কার্যক্রম শুরু করলাম। এখন পেশাগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেলেও আমাদের ভালো কাজের প্রয়াসটা অটুট রয়েছে। বর্তমানে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ মানুষের খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য ক্ষুধার্ত মানুষকে একবেলা খাবার দিয়ে তাদেরকে ভালো কাজে উৎসাহিত করা। স্বপ্ন দেখি, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে একটা সময় মানুষ যেন বলতে পারে বাংলাদেশে অনেক ভালো কাজ হয়।