জাতীয়

পিস্তলের বাঁট দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় নাঈমের দাঁত

শনিবার রাত সাড়ে ৮টা। রাজধানীর শাহবাগ থানার তদন্ত বিভাগের পরিদর্শকের কক্ষে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া হয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈমকে। এর পরই শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। পুলিশ সদস্যরা কিল-ঘুসি মারতে থাকেন, বুটের লাথি পড়তে থাকে তার শরীরে। পিস্তলের বাঁট দিয়ে মুখমণ্ডলে চলতে থাকে একের পর এক আঘাত। ভেঙে দেওয়া হয় দাঁত। নির্যাতনে অংশ নেওয়া প্রায় সবার মুখ ছিল মাস্ক দিয়ে ঢাকা।

তবে নেতৃত্বে ছিলেন রমনা বিভাগের এডিসি হারুন-অর-রশীদ। ঘটনার শিকার নাঈমের ভাষ্য, যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন হারুন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পুলিশি নির্মমতার সাক্ষী নাঈম। গতকাল রোববার কালবেলার কাছে বিবরণ দেন শনিবার রাতের ভয়ংকর ঘটনার। তিনি জানান, টানা আধাঘণ্টা ধরে চলে নির্মম নির্যাতন। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে হয়তো মারা যাব।

জ্ঞান হারানোর আগে এডিসি হারুনকে বলেছিলাম, আপনি না ছাত্রলীগের পরিচয় দেন। আমিও তো ছাত্রলীগের নেতা। এমন আচরণ করছেন কেন?’ এ কথা শোনার পর পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বলেও জানান নাঈম। হারুন তখন বলতে থাকেন, ‘কীসের ছাত্রলীগ? নিজ যোগ্যতায় এখানে আসছি। আমি ছাত্রলীগের কেউ না। নির্যাতনের পাশাপাশি হারুন ওই ছাত্রলীগ নেতাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন বলেও অভিযোগ তার।হাসপাতালের বিছানায় শোয়া নাঈমের কানে ও গালে এখনো জমাটবাঁধা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।

ঠোঁটে পড়েছে ৮ থেকে ১০টি সেলাই। দাঁতের পাটির সামনের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। কান্নাজড়িত অস্পষ্ট স্বরে নাঈম বলেন, এডিসি হারুন পিস্তলের বাঁট দিয়ে আমার দাঁতগুলো ভেঙেছে। কয়েকটি পুরোপুরি ভেঙে গেলেও সব দাঁতই এখন নড়বড়ে অবস্থায়। মারতে মারতে পুরো মুখমণ্ডল রক্তাক্ত করেছে। অঝোরে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল, তাতেও মন গলেনি সেই কক্ষে থাকা কারোর।থানায় নিয়ে কেন এই নির্যাতন: ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈম আরও জানান, ঘটনার রাতে তিনি এবং শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিম শাহবাগ হয়ে ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলেন।

বারডেম হাসপাতালের সামনে সরকারি কর্মকর্তা এক বড় ভাইকে দেখতে পাই। তিনি তখন লিফটে করে কার্ডিওলজি বিভাগে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর, সেখানে গিয়ে দেখি, ওই ভাই ও এডিসি হারুনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। তখন আমরা মীমাংসার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ পর এডিসি হারুন ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশকে ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে ডেকে আনেন। তারা এসে আমাদের তিনজনের ওপর চড়াও হন। সেখান থেকে মারতে মারতে মুনিমকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।তিনি আরও জানান, ওই ঘটনার পর শাহবাগ থানায় যাই।

থানায় ঢোকামাত্র এডিসি হারুন অন্য পুলিশ সদস্যদের আমাকে দেখিয়ে বলেন, ও আমাকে মারছে। এখন তোরা ওকে মার। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হারুনের নেতৃত্বে শুরু হয় পৈশাচিক নির্যাতন।কালবেলা বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে, এডিসি হারুন পুলিশ ক্যাডারের এক নারী কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। ঘটনার রাতেও হারুন বারডেমে ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তার কাছে গেলে বিষয়টি টের পান তার স্বামী। তখন তিনি ছাত্রলীগ নেতা নাঈম ও মুনিমকে নিয়ে সেখানে গিয়ে হারুনকে হাতেনাতে ধরেন।

এর জেরে মুনিমকে থানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে নাঈম থানায় গেলে তার ওপর নজিরবিহীন পৈশাচিতকতা চালান হারুনসহ পুলিশ কর্মকর্তারা।আহত নাঈম আরও বলেন, পুলিশের ওই কর্মকর্তার (এডিসি হারুন) সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। আরেক সরকারি কর্মকর্তার ফোন পেয়ে থানায় গেলে নির্যাতন শুরু করেন। থানার ভেতর ওসির কক্ষে গিয়ে নিজের পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার ওপর আক্রমণ করেন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

পরে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি। এ সময় পুরো শার্ট রক্তে ভেজা ছিল। কান ও গাল বেয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছিল।তিনি বলেন, নির্যাতনকারীরা সবাই ছিল মুখোশ পরা। নেমপ্লেট খুলে রেখে আমাকে পিটিয়েছে, যাতে চিনতে না পারি। দু-তিনজনের মাস্ক টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। তাদের সামনে আনলে শনাক্ত করতে পারব।নাঈমের খালা ফেরদৌস রত্না কালবেলাকে বলেন, কোনো মায়ের সন্তান যেন ছাত্রলীগ করার কারণে মৃত্যুশয্যায় না লড়ে। ছেলেটাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। ১০ থেকে ১৫ জন যদি একজনকে আঘাত করে, তাহলে তার তো বেঁচে থাকার কথা নয়।

এডিসি হারুন পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করেছেন, নাক-মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত পড়েছে আমার ছেলের। এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।তিনি আরও বলেন, খবর পেয়ে নাঈমকে উদ্ধার করে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।নাঈমের ভাষ্য অনুযায়ী, পরিদর্শক (তদন্ত) শাহে আলমের কক্ষে ওই নির্যাতন হয়। এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে গতকাল তার সরকারি মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি তা ধরেননি।

পুরো ঘটনা জানতে শনিবার রাতেই এডিসি হারুন অর রশিদের সঙ্গে কথা বলে কালবেলা। যদিও তিনি দাবি করেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে কালবেলায় গতকাল প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাকে প্রথমে রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে বদলি করা হয়। বিকেলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক আদেশে তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়েছে।

আরও খবর

Sponsered content

%d bloggers like this: