রাজনীতি

সঠিক রাজনীতি করতে গেলেই সরকার আমাদের দল ভেঙে দেওয়ার অপচেষ্টা করে বললেন জিএম কাদের

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, ১৯৯০ সালের পর জাতীয় পার্টি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে আমাদের দেশের দলগুলো টিকতে পারে না। ক্ষমতাসীনরা জুলুম-নির্যাতন করে আমাদের রাজনীতি করতে দেয়নি। যারা ক্ষমতাসীন দল করতে এসেছিল তারা নব্বই সালের পর দল ছেড়ে চলে গেছে। তারা দল বা দেশের স্বার্থ দেখেনি। ২০০৮ সালে যখন আমরা মহাজোট করেছি, তখন অনেকেই বলেছে, আমরা পরজীবী হয়ে গেছি। তারা বলেছেন, আমরা নাকি অন্যের সহায়তা ছাড়া নির্বাচনে জয়ী হতে পারি না। তিনি আরও বলেন, দেশের বড় দুটি দলের নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয়। সেই অল্প ভোট তো আমরা দিতে পারতাম। আমরা যদি পরজীবী হই তারপরও আমাদের কাছে টানতে প্রতিযোগিতা ছিল।

সেখানে আমাদের একটি বার্গেনিং পয়েন্ট ছিল, আমরা বার্গেনিং করে অনেক কিছু আদায় করতে পারতাম। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে আমরা বার্গেনিং করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমাদের বলা হয় গৃহপালিত রাজনৈতিক দল। আমাদের দলের মধ্যে সরকারি দলের এজেন্ট ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা আমাদের দল করে কিন্তু রাজনীতি করে অন্য দলের। আমাদের দল করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেয়, কিন্তু রাজনীতি করার সময় তারা সরকারি দলের রাজনীতি করে। যখনই আমরা সঠিক রাজনীতি করতে চাই, তখনই আমাদের দলকে ভেঙে আরেকটি দল সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। এটা সরকারই করে যাতে আমরা স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে না পারি। শনিবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে নিজের জন্মদিনের আয়োজনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জিএম কাদের এসব কথা বলেন।

এর আগে পার্টি চেয়ারম্যানের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সকাল থেকেই জাতীয় পার্টি এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্র্মীরা ফুল এবং মিষ্টি নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে জড়ো হন। তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলেন অফিস এলাকা। এ সময় পার্টি চেয়ারম্যানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায় দোয়া এবং মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও জাতীয় মহিলা পার্টির আহ্বায়ক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, নাজমা আখতার, মোস্তফা আল মাহমুদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির সভাপতি শেরীফা কাদের, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান এ সময় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেন, আগে আমরা পরজীবী হলেও আমাদের একটা পছন্দ ছিল, আমরা যে কোনো পক্ষে যেতে পারি, আমাদের বার্গেনিং পয়েন্ট ছিল। এখন আমরা বন্দি হয়ে গেছি, একজনের কাছেই যেতে হবে। আমরা সঠিক রাজনীতি করতে গেলেই একজন একটা ডাক দেবেন, সরকার মদদ দেবেন, মিডিয়া কাভারেজ দেবে আর আমাদের দল ভেঙে এবং আইনের মাধ্যমে আমাদের লাঙ্গল নিয়ে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। দল বাঁচাই, না রাজনীতি বাঁচাই-এ সমস্যায় জাতীয় পার্টি ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমরা লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকতে পারি না। আমাদের দলে থেকে যারা অন্য দলের রাজনীতি করে তাদের আমরা দল থেকে বের করে দিতে পারি না।

বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, রাজনীতি বাঁচাতে আমাদের ঝুঁকি নিতে হবে। সরকার আমাদের দুর্বল করতে আমাদের মাঝেই একটি জোট বানিয়ে রাখছে। আমরা সঠিক রাজনীতি করতে গেলেই সরকার আমাদের দল ভেঙে দেয়ার অপচেষ্টা করে। যারা জাতীয় পার্টি ব্যবহার করে অন্য দলের রাজনীতি করতে চায় তাদের দল থেকে বের করে দিতে হবে। এটা করতে পারলেই জাতীয় পার্টি টিকবে। দেশ ও জাতির কাছে গৃহপালিত বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা নেই। আমরা একটি দলের কাছে বন্দি হয়ে গেলে জনগণের কাছে আমাদের প্রয়োজন থাকবে না। আর জনগণ কেন এমন দলকে ভোট দেবে? দলকে বাঁচাতে হলে গৃহপালিত অপবাদ থেকে বের হতে হবে। যারা গৃহপালিত হওয়ার জন্য দায়ী তাদের বর্জন করতে হবে।

আমাদের দলে থেকে অন্যদলের রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। সরকারকে অনুরোধ করব দেশের রাজনীতি শেষ করবেন না। রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করতে দেন। সবাইকে ধ্বংস করে সরকার একক রাজনীতি করবে এটা দেশ ও জাতির জন্য ভালো হবে না।তিনি বলেন, আরও কিছু দিন পরে আমার সঠিক মূল্যায়ন হবে। এখন যারা আমাকে মূল্যায়ন করছেন সেটা হয়তো সঠিক হচ্ছে না। সময়ের ব্যবধানে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। গেল নির্বাচনে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। দেখেছি রাজনীতি কত নোংরা হতে পারে, আবার কত মহৎ হতে পারে। দেখেছি ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য মানুষ কত নিচে নেমে যেতে পারে।

দেখেছি দেশ ও জাতির জন্য মানুষ কত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। এগুলো আমার চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে। আল্লাহতায়ালা যেন এই শিক্ষাগুলো দেশ এবং জাতির স্বার্থে কাজে লাগাতে দেন।ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। আমাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়নি, আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হচ্ছিল না। তখন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও সংশয় ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করেছিল। আমরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলাম, আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সংগ্রাম করেছিলাম। সেই আন্দোলনেই আমাদের ভাষাশহিদরা জীবন দিয়েছিলেন। বৈষম্য দূর করতেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল।

মায়ের ভাষায় কাজ করতে না পারলে আমাদের সন্তানরা ভালো চাকরি পাবে না, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাঙালিদের কোনো মর্যাদা থাকবে না। আমরা শহিদ মিনার করে ভাষাশহিদদের সম্মান জানাচ্ছি। কিন্তু যে বৈষম্য দূর করতে ভাষাশহিদরা জীবন দিয়েছিলেন, সেই বৈষম্য কি দূর হয়েছে? ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রতিদিন বাড়ছে, দলীয়করণের মাধ্যমে বৈষম্য চলছে। এটা কি অন্যায় নয়? তিনি বলেন, সরকারি দল করলে এক নিয়ম ও সুযোগ-সুবিধা আর সাধারণ মানুষের জন্য অন্য নিয়ম। এটা বৈষম্য এবং অন্যায়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম হয়েছিল। সেই অন্যায় এখনো চলছে।

বৈষম্য ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে একুশে আমাদের শিক্ষা দেয়। একুশের মূল মেসেজ হচ্ছে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়া। কিন্তু বর্তমান সরকার বৈষম্যের দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছে, রাষ্ট্রীয়ভাবেই বৈষম্য করা হচ্ছে। চাকরি পেতে গেলে জিজ্ঞেস করা হয় তুমি ও তোমার পরিবার কি আওয়ামী লীগ করে? আওয়ামী লীগ না করলে চাকরি মেলে না। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তো একুশের সংগ্রাম। একুশের চেতনা ভূলণ্ঠিত হচ্ছে। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ছয় দফা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে। যেটাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বলি। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা জয়ী হলেও মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারিনি।

আরও খবর

Sponsered content

%d bloggers like this: