জাতীয়

কর্তাদের ভয়ংকর থাবা গরিবের টাকায়

অতিদরিদ্র মানুষের দরিদ্রতা দূর করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার কথা যাদের, তারাই লোপাট করেছেন গরিবের টাকা। দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ করা টাকা তাদের মাঝে বিতরণ না করে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে পকেটে ঢুকিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা। আবার মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে নামসর্বস্ব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করা হয়েছে গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত শত শত কোটি টাকা। এই তালিকায় আলোচিত পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ফলে লাভ দূরের কথা, বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আবার স্বাস্থ্যসেবার নাম করে গরিব মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে করা হয়েছে আত্মসাৎ।

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) অর্থ লোপাট ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির এমন ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে এসেছে খোদ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে এই দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে তদন্ত কমিটি জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করলেও তা কার্যকর হয়নি।অভিযোগ আছে, পিডিবিএফের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোদন মোহন সাহা এসব দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত। আর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মওদুদ উর রশীদ সফদরের স্বেচ্ছাচারিতায় অনিয়ম-দুর্নীতি বেপরোয়া গতি পেয়েছে।

এরপরও ৩ বছরের চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই মাস আগেই তড়িঘড়ি করে তার চুক্তির মেয়াদ আরও ৩ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সংস্থাটির ৯৪তম বোর্ড সভায় নজিরবিহীন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন এক প্রতিমন্ত্রীপুত্র। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, একই বোর্ড সভায় প্রবিধান সংশোধন করে গেজেট প্রকাশের আগেই সংশোধিত প্রবিধানের বলে মওদুদ উর রশীদ সফদরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ।এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির প্রধান মো. আফজাল হোসেন (ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব হওয়ার পর তিনি অবসরে যান) যুগান্তরকে বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল মন্ত্রণালয় ও পিডিবিএফ কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত এমডি ছাড়া কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পিডিবিএফ’র নানা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করতে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন সমবায় মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (প্রতিষ্ঠান) আফজাল হোসেন। তদন্ত শেষে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। তদন্তে বিস্ময়কর অনেক ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা উঠে আসে।জানতে চাইলে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য যুগান্তরকে বলেন, ‘কামাল উদ্দিন তালুকদার সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকার সময় এসব ঘটনা ঘটেছিল। তখন পিডিবিএফে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল। পরে সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। এখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে পিডিবিএফের পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমেই নিতে হবে। কিন্তু কামাল তালুকদার তার নিজের লোকদের দিয়ে বোর্ড সাজিয়েছেন। সেই চেইন এখনো ভাঙেনি। এখন ব্যবস্থা নিতে হলে বোর্ডের অনুমতি ছাড়া কঠিন।

গরিবের টাকা আত্মসাৎ : দুদক ও মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টের সূত্র ধরে জানা গেছে, পিডিবিএফের বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ‘সেবা নীড়’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল গ্রামের দরিদ্র নারী-পুরুষ আজীবন সদস্য ফি বাবদ ২০০ টাকা ও বার্ষিক ফি ৪০০ টাকাসহ মোট ৬০০ টাকা দিয়ে সদস্য হতে পারবেন। পরবর্তী বছরের জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা। এভাবে ৪০৩টি কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রচুরসংখ্যক সদস্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের কাছ থেকে উত্তোলন করা হয় ৪ কোটি টাকার বেশি। তাদের স্বাস্থ্যসেবাদানের জন্য অ্যাডভিন লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ ৮০ হাজার ২৫০ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, এ প্রকল্পের মাধ্যমে কাউকে কোনো স্বাস্থসেবা দেওয়া হয়নি। অথচ ময়মনসিংহের ভালুকা কার্যালয় থেকে সদস্য ফি বাবদ ১ লাখ ২ হাজার টাকা, সিডস্টোর কার্যালয় থেকে ৭৭ হাজার ৮০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। এভাবে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর, ঘাটাইল, বাসাইল, গোপালপুর, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, চেচুয়াবাজারসহ সারা দেশ থেকে ৪ কোটির বেশি টাকা দরিদ্রদের কাছ থেকে তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

ভুয়া বিলে টাকা লোপাট : পিডিবিএফের সাবেক যুগ্ম পরিচালক বর্তমানে (অবসরপ্রাপ্ত) শহিদুল হক খান ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। এর মধ্যে পিডিবিএফের সহকারী পরিচালক ফাতেমা খাতুনের নামে ২ লাখ ৫০ হাজার ও পরিণীতা রায়ের নামে ২ লাখ টাকা বিল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে দুজনেই লিখিত দিয়েছেন তাদের এ বাবদ কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের মামলা পরিচালনার জন্য মাহবুব আলম নামের একজন আইনজীবীকে ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আব্দুর রহমান নামের আরেক আইনজীবীকে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো চেকের মুড়ি বইতে তাদের কোনো স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা গেছে, চেকগুলো বিয়ারার চেকের মাধ্যমে নগদায়ন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি মনে করে এই টাকা দুজনে যোগসাজশ করে আত্মসাৎ করেছেন। তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরও প্রতিমন্ত্রীর কাছের লোক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নির্বিঘ্নে চাকরি করে তিনি গত ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যান। অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা শহীদুল হক খান বলেন, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা যদি একটি ফাইল আনতে বলেন, তাহলে সেটা অধীনস্থ কর্মকর্তা না করে পারে না। ওই সময়ে এ রকমটিই ঘটেছিল।

পিকে হালদারের কোম্পানিতে গরিবের টাকা : পিডিবিএফের ৬৮তম বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেসব বেসরকারি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিতে পিডিবিএফের টাকা বিনিয়োগ করা আছে, সেগুলো তুলে সরকারি ব্যাংকে রাখতে হবে। পাশাপাশি এসব অর্থ দেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। আর কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে না। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পিডিবিএফের ৬৭ কোটি ৩৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বিভিন্ন ভুঁইফোড় লিজিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত অর্থ লোপাটকারী প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেডে বিনিয়োগ করা হয়েছে ২৬ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা। এছাড়া প্রিমিয়ার লিজিং নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ৪ কোটি ৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কোম্পানি লভ্যাংশ তো দূরের কথা, আসলই ফেরত দেয়নি।

এভাবে ১৫টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পিডিবিএফের ১০০ কোটি ৪২ লাখ ৫ হাজার টাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছেন দায়িত্বশীলরা। এর বাইরে মিডল্যান্ড নামের একটি আনকোরা ব্যাংকে আরও ১০৪ কোটি ১৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছে। দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যয়িত অর্থের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি।এ প্রসঙ্গে পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মওদুদ উর রশীদ সফদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার আমলে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। পূর্ববর্তী কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িত ছিল। মন্ত্রণালয় একাধিকবার তদন্ত করে তা নির্ণয় করেছে।

তাদের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল, তাদের অনেকেই চাকরি থেকে বিদায় নিয়েছেন। হয়তো তারাই এখন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে বেড়াচ্ছে। তাদের দুর্নীতির বিষয় মন্ত্রণালয় দুদকের কাছে লিখেছে। দুদক এখন বিস্তারিত তদন্ত করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠানে আগের কর্মকর্তারা টাকা রেখেছেন। আমরা অনেক টাকা আদায় করেছি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বলবৎ আইন ও হাইকোর্ট আর সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত একত্রিত করেই আমার ব্যাপারে বোর্ডের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখানে (বোর্ডে) অনেক সিনিয়র লোকজন আছেন।

আরও খবর

Sponsered content