4 October 2023 , 1:27:50 প্রিন্ট সংস্করণ
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই সরকারকে আলটিমেটাম দিয়ে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে নামতে যাচ্ছে বিএনপি। আগামী ২০ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাওয়া শারদীয় দুর্গাপূজার দু-এক দিন আগে ঢাকায় বড় সমাবেশ থেকে এই আলটিমেটাম দিতে পারে দলটি। দুর্গাপূজা শেষ হওয়া পর্যন্ত এ আলটিমেটাম চলতে পারে। দাবি না মানলে পূজার পর থেকে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে পা রাখবে বিএনপি; যা আগামী নভেম্বরের প্রথমে তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত এমনকি তপশিলের পরেও চলতে পারে।
২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত দুর্গাপূজার সময় বড় কোনো কর্মসূচি রাখবে না দলটি। মার্কিন ভিসা নীতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের তপশিলের আগেই আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। গত সোমবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে চূড়ান্ত আন্দোলন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় যুব ও ছাত্র কনভেনশন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর স্মারকলিপির কর্মসূচিও রয়েছে। সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়ার আগে চলতি মাসে পর্যায়ক্রমে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। এই সময়ের মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচিও চলতে থাকবে। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
একদফা দাবিতে ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে এখন রোডমার্চ ও সমাবেশের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। আগামীকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোডমার্চের মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ের কর্মসূচি শেষ হবে। এরই মধ্যে রাজধানী ও এর আশপাশের জেলায় আটটি সমাবেশ হয়েছে। রোডমার্চ হয়েছে চারটি। এ ছাড়া ঢাকায় মহিলা সমাবেশ, শ্রমিক কনভেনশন ও কৃষক সমাবেশ হয়েছে। আজ বুধবার ঢাকায় পেশাজীবী কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে ১২ জুলাই থেকে একদফার আন্দোলন শুরু করে বিএনপি।
দলটির নেতাদের মূল্যায়ন, এসব কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। শ্রমিক কনভেনশনের মধ্য দিয়ে একদফার চলমান আন্দোলনে আগামীতে শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। এতে আন্দোলন বেগবান হবে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। চলমান কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর আরও শক্তভাবে মাঠে নামবেন তারা, যা হবে সরকার পতনের চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি।জানা যায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বিএনপির রোডমার্চ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। অথবা প্রথম ধাপের কর্মসূচি শেষে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেও ঘোষণা করা হতে পারে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের আংশিক কর্মসূচি। এর আগে গত কয়েকদিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে যুগপতের শরিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে বিএনপি। তাদের দেওয়া বিভিন্ন প্রস্তাবনা সমন্বয় করে চূড়ান্ত আন্দোলন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দলটি।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রথম ধাপের কর্মসূচি শেষে ৭ অক্টোবর থেকে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন শুরু হতে পারে। ১৮ অক্টোবরের দিকে সরকারকে পদত্যাগে আলটিমেটাম দেওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও কিছু কর্মসূচি হতে পারে। আলটিমেটাম শেষে কর্মসূচি হবে ঢাকাকেন্দ্রিক। তখন সারা দেশের নেতাকর্মীরা ঢাকার কর্মসূচিতে যোগ দেবেন।এর আগে ২৭ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি; কিন্তু পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় একদিন পিছিয়ে পরদিন ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ওই মহাসমাবেশ করে দলটি। সেখান থেকে সরকারকে পদত্যাগে আলটিমেটাম দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা ছিল বিএনপির হাইকমান্ডের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছিল দলটি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের মারমুখী ভূমিকা এবং নেতাকর্মীরা ব্যাপক হারে রাজপথে না নামায় তখন ওই কর্মসূচি সফল হয়নি।
চূড়ান্ত আন্দোলন সামনে রেখে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে কিছু সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয় চাপে পড়া বিএনপি। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই চূড়ান্ত আন্দোলন পরিকল্পনা সাজিয়েছে দলটি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য পরিবারের আবেদন বাতিল হওয়ায় একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনে এই ইস্যুটি এখন জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করবে বিএনপি।আরও জানা যায়, চলতি অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় একদফার যুগপৎ আন্দোলন বেগবান করবে বিএনপি। এ সময় যুব ও ছাত্র কনভেনশন করতে চায় দলটি। ছাত্র কনভেনশনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বটতলায় করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২৯ সেপ্টেম্বর ১৫টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য’র আত্মপ্রকাশ হয়েছে।
একদফার চূড়ান্ত আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পৃক্ত করতে চায় বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা। তারা মনে করছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে না পারলে চলমান আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা পাওয়া কঠিন। এদিকে যুব কনভেনশন সফলে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের সমন্বয়ে শিগগির ‘যুব ঐক্যজোটে’র আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে।এদিকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি) বরাবর স্মারকলিপি দিতে পারে বিএনপি। স্মারকলিপিতে পুলিশকে চলমান হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার বন্ধ এবং ইসিকে সম্ভাব্য একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ না নেওয়ার আহ্বান জানানো হতে পারে।
অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা করতে পারেন, সেজন্য আগামী ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পূজা চলাকালে বড় কোনো কর্মসূচি রাখছে না বিএনপি।বৈঠক সূত্র আরও জানায়, সরকার আলটিমেটাম মেনে পদত্যাগ না করলে দুর্গাপূজার পরে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে নামবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। সেক্ষেত্রে ঘেরাও দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের এ আন্দোলন শুরু হতে পারে। শুরুতেই সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এরপর পর্যায়ক্রমে গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে পারে তারা। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। একেবারে বাধ্য না হলে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি।
বিএনপি নেতারা জানান, চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে বিএনপি ও তার মিত্রদের কর্মসূচি কেমন হবে, তা সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে। সরকারের আচরণ কঠোর হলে কর্মসূচিও কঠোর হবে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পর তার মনোভাব কেমন হয়, তা পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি ও তাদের শরিক দলের নেতারা। এর ওপর নির্ভর করবে বিরোধী পক্ষের কর্মসূচির ধরন কেমন হবে। বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা জানান, চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি হবে লাগাতার এবং রাজধানী ঢাকার ওপর থাকবে আন্দোলনের মূল ফোকাস।স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, দলের নীতিনির্ধারকরা সভায় বলেছেন, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসাকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে নিয়ে সরকার বিএনপিকে কাবু করতে চায়। কোনো ধরনের ঘুঁটি হিসেবে তাদের চেয়ারপারসন ব্যবহৃত হবেন না বলে মত রাখেন তারা। এ ছাড়া বৈঠকে পরিবারের আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে নাকচের পরে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দিতে বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত হয়, যা গতকাল অনুষ্ঠিত দলের সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়েছে।