পরিবেশ

আয়ু কমেছে সবার গড়ে ৬ বছর ৮ মাস করে

বায়ু দূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২ বছর ৪ মাস। অন্যদিকে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস।মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত ‘বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বাপার যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণ বিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ এ তথ্য উঠে এসেছে।লিখিত বক্তব্যে আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, গাজীপুর জেলার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা যার ব্যাস সাধারণত ২.৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোটটির (পিএম ২.৫) পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯.৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এই মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মান মাত্রার (অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মান মাত্রার চেয়ে ৬ গুণ বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ -এর জন্য নির্ধারিত (বার্ষিক) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দূষিত জেলা হিসেবে পাওয়া গেছে সিলেট শহর। যার প্রতি ঘনমিটাবে ৪৮.৫ মাইক্রোগ্রাম এবং এটি ডব্লিউএইচও’র নির্ধারিত মান মাত্রার চেয়ে ৯.৭ গুণ বেশি এবং বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় গাদর্শ (বার্ষিক) মান মাত্রার চেয়ে ৩.২৩ গুণ বেশি।তিনি বলেন, গাজীপুর ছাড়াও নোয়াখালীতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.৭ মাইক্রোগ্রাম, কুমিল্লাতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.২ মাইক্রোগ্রাম, চাঁদপুরে প্রতি ঘনমিটারে ৮৭.৮ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকাতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৭.২ মাইক্রোগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এ প্রতি ঘনমিটারে ৮৬.৯ মাইক্রোগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৩.১ মাইক্রোগ্রাম, কিশোরগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮২ মাইক্রোগ্রাম এবং টাঙ্গাইলে প্রতি ঘনমিটারে ৮১, মাইক্রোগ্রাম অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ এর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

বায়ু দূষণের কারণ উল্লেখ করে আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বায়ু দূষণের কারণগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যতম। ক্যাপসের গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৬.৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজের থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।

বাপার যুগ্ম সম্পাদক আরও বলেন, এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু ২ বছর ৪ মাস কমছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস। এছাড়া ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইডিসিএইচ) ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৭ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার।

অন্যদিকে, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসেবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের (২০২৩) জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে। আয়ুষ্কালের পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, দূষণ বাংলাদেশে মানব স্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে জানিয়েছে কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সিসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হন ১ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। আবার এ দূষণের কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে। ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।বায়ুমান উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ, মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পদক্ষেপগুলো নিচে দেওয়া হলো—

স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ
নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়ারেজ অথরিটির (ওয়াসা) এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

রাস্তায় আবর্জনা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদবাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে, দূষিত শহরগুলোর আশেপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে সেন্ড বক্লের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।

পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।র্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারাদেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব, বাপার সভাপতি নুর মোহাম্মদ তালুকদার, সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর প্রমুখ।

আরও খবর

Sponsered content