অপরাধ বার্তা

কুমারখালীতে ৮৯ ট্রান্সফরমার চুরি

২৩ দিন হলো খাম্বার ট্রান্সমিটার চুরি হয়ছে। সাতঘরে কারেন্ট নাই। বেটারা কলো অর্ধেক টাহা জমা দিতি হবি। গরির মানুষ। ৩১ হাজার টাহায় কি কম হলো! কিনার পয়সাও নি। তাই সেকালের মতো আবার চেরাগ (কুপি) জ্বালাচ্ছি। কষ্ট হলিও কিচ্ছু করার নেই। ‘ গত সোমবার সন্ধায় আক্ষেপ করে কথা গুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ষাটোর্ধ বৃদ্ধ আম্বিয়া খাতুন। তিনি উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের দমদমা গ্রামের বৃদ্ধ হাসান আলীর স্ত্রী। ওই বৃদ্ধ দম্পতির তিন ছেলে। তাঁদের মধ্যে কামিরুল দিনমজুর। আর জামিরুল ও আমিরুল পেশায় ভ্যানচালক। এই দম্পতি বৃদ্ধ বয়সে ভাগেযোগে সন্তানের ঘরে খায়ে পরে জীবনধারণ করছেন। আম্বিয়ার ভাষ্য, টাহা দিয়ে লাগালিই তো হচ্ছেনা। আবার যে চুরি হবেনা, তার গিরান্টি কিডা দিবি? বেটারা কয়া (বলে) গেছে আবার চুরি হলি পুরা (সব) টাকাই দিতি হবি। এসব নিয়েও আতঙ্কিত তিনি। গত ১ ডিসেম্বর রাতে তাঁদের গ্রামের একটি দশ কিলো ভোল্ট অ্যাম্পিয়ার (কেভিএ) ট্রান্সফরমারের খোলস ফেলে ভিতরের যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনা ঘটেছে। পল্লী বিদ্যুতের নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক এলাকার ট্রান্সফরমার চুরি হলে গ্রাহকরা অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করার পর পুনরায় বিদ্যুত সংযোগ দেওয়া হয়। সেই হিসাবে ১০ কেভিএ ট্রান্সফরমারের অর্ধেক দাম প্রায় ৩১ হাজার টাকা জমা না দেওয়ায় ওই এলাকায় ২৩ দিন ধরে বিদ্যুত নেই। এতে সাতটি পরিবার পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। গ্রাহকদের ভাষ্য, পরিবার গুলোর কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ অন্যের জমি বর্গা চাষ করে, আবার কেউবা দিনমজুরী করে জীবিকার্জন করে থাকেন। সেজন্য টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছেনা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ভাঁড়রা-বাঁশগ্রাম বাজার সড়কঘেঁষে অবস্থিত দমদমা গ্রামটি। সেখানকার সাতটি বাড়তে মিটার থাকলেও নেই বিদ্যুত। কেউ কিরোসিন তেল দিয়ে কুপি জ্বালাচ্ছেন। কেউবা চার্জার লাইট ব্যবহার করে প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। এসময় ভ্যানচালক আলমগীরের স্ত্রী শারমিন খাতুন বলেন, বিদ্যুত নেই। পাশের গ্রাম থেকে পপ্রতিদিন ভ্যান চার্জ দিয়ে চলছে সংসার। বিদ্যুত না থাকায় ছেলে মেয়ের পড়াশোনাসহ নানান সমস্যা হচ্ছে। তাঁর ভাষ্য, ট্রান্সফরমার কেনার জন্য মিটার প্রতি পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা ধরা হয়েছে। দিনমজুর কামিরুল বলেন, সংসারের খরচ মিটিয়ে ভাগের পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব নয় এখনই। সেজন্য আপাতত বিদ্যুতও নেওয়া হচ্ছেনা। কষ্ট হলেও মানতে হবে। পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরে উপজেলায় অন্তত ১৮ টিসহ গেল আড়াই বছরে ৮৯টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি চুরির ঘটনায় থানায় লিখিত এজাহার দেওয়া হলেও মামলা নেয়নি পুলিশ। কোনো চোর ধরা পড়েনি। মালামালও উদ্ধার হয়নি। চোরের কাছে অসহায় গ্রাহক ও কর্মকর্তারা। কুমারখালী পল্লী বিদ্যুত সমিতির জোনাল কার্যালয় ও বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৭ ডিসেম্বও পর্যন্ত ১৮ টি ট্রান্সফরমারের খোলস রেখে ভিতরের যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও ২০২২ সালের মে মাস থেকে ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো ৬৭ টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। তারমধ্যে ৬৮ টি ৫ কেভিএ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। প্রতিটি ৪২ হাজার টাকা হিসাবে ৬৮ টির দাম প্রায় ২৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। আর ১০ কেভিএ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ১৮ টি। প্রতিটি ৬২ হাজার টাকা হিসাবে ১৮টির মূল্য ১১ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এছাড়াও ১৫ কেভিএ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ টি। প্রতিটি ৭৭ হাজার ৮০৫ টাকা মূল্যে ৩ টির দাম প্রায় দুই লাখ ৩৩ হাজার ৪১৫ টাকা। চুরি যাওয়া যাওয়া ট্রান্সফরমারের মধ্যে মাত্র দুইটি আবাসিক এলাকার। একটি করে করাতকল ও রাইচ মিলের। আর বাকী সব কুষিকাজে ব্যবহৃত সেচ প্যাম্পের। মাস দুয়েক আগে একরাতে করাতকলের ১০ কেভিএ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন দুইটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়ে যায়। সপ্তাহখানেক পরে ধারদেনা করে অফিসে এক লাখ ১৭ হাজার টাকা জমা দিয়ে লাইন চালু করেছি বলে জানান সিরাজুল ইসলাম। উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের বাঁশআড়া এলাকায় তাঁর করাতকলের ব্যবসা। গত ১৪ আগষ্ট রাতে যদুবয়রা ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের মাঠে কৃষক মো. আকরাম হোসেনের সেচ প্যাম্পর ১০ কেভিএ একটি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ছয় মাসে দুইবার তাঁর ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। একটি ট্রান্সফরমারের দাম প্রায় ৬২ হাজার টাকা। তাঁর ভাষ্য, চুরির আতঙ্কে রাতে ঘুম হয়না তাঁর। তিনি নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি জানান। নিয়মানুযায়ী চুরি যাওয়া ট্রান্সফরমারের অর্ধেক টাকা জমা না দেওয়ায় দমদমা গ্রামে বিদ্যুত সংযোগ বন্ধ রয়েছে বলে জানান কুমারখালী পল্লী বিদ্যুত সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ( ডিজিএম) মো. আনসার উদ্দিন। তিনি বলেন, অজ্ঞাত সংঘবদ্ধ চক্র নিয়মিত ট্রান্সফরমার চুরি করছে। প্রতিটি ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিলেও মামলা হয়নি। চলতি বছরে ১৮ টিসহ গেল আড়াই বছরে ৮৯ টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। তাঁর ভাষ্য, চক্রটি পরিকল্পিত ভাবে ফাঁকা ও নির্জন মাঠের সেচ প্যাম্পের ট্রান্সফরমার গুলো চুরি করছে। মামলা না নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে কুমারখালী থানার ওসি মো. সোলায়মান শেখ বলেন, ১ ডিসেম্বর থানায় যোগদানের পর দুইটি ট্রান্সফরমার চুরির এজাহার জমা পড়েছে। তবে এজাহারে ত্রুটি থাকায় মামলা রুজু হয়নি। বিদ্যুৎ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দমদমা গ্রামে বিদ্যুত চালু করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি বলেন, চুরি ঠেকাতে পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হবে।