জাতীয়

বাংলাদেশের বাড়ছে দরকষাকষির সক্ষমতা

চীনা ঋণের যে কোনো শর্ত মানছে না বাংলাদেশ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হলেই শুধু ঋণ নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি একটি ঋণে কঠিন শর্ত দিয়েছিল চীন। এমনকি প্রকল্প চলাকালে চীনের নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন হলে শর্ত ছাড়াই নোটিশ দিয়ে সম্পূর্ণ অর্থায়ন বাতিলের ক্ষমতা চেয়েছিল দেশটি। সেই সঙ্গে উচ্চ প্রতিশ্রুতি ও ব্যবস্থাপনা ফি, কম ম্যাচুরিটি ও সহজলভ্য পিরিয়ড সংক্রান্ত শর্তও দেয়। তারা বলেছিল, অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে চীনা আইন। যে কোনো সালিশ নিষ্পত্তি হবে বেইজিংয়ে। চীনের এসব প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি জানিয়ে ফিরতি প্রস্তাব পাঠায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। পরে আলাপ-আলোচনার পর অনেক শর্তই শিথিল হয়ে যায়।

ফলে চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাস্তবায়ন হচ্ছে ‘রাজশাহী ওয়াসা সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটি। এরকম অন্য ঋণগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেছে। অনেকের মতে, এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ দরকষাকষির সক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছে। তবে এটাকে বাংলাদেশ ও চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিদর্শন হিসাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে ইআরডির সচিব শরিফা খান বলেন, ‘সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের দরকষাকষির সক্ষমতা বেড়েছে। আমাদের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা না বাড়লে বড় বড় বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছি কিভাবে? এসব ঋণের শর্ত, আইনকানুন, সুবিধা ও অসুবিধা সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেই নেওয়া হচ্ছে।

চীনা ঋণের প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজশাহী ওয়াসার যে ঋণটির উদাহরণ দিলেন, এতে বলাই যায় নেগোশিয়েশনে সক্ষমতা বেড়েছে। তবে ইআরডির কর্মকর্তাদের আরও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজন আছে। তাদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণসহ বিদেশ সফরের মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। তারা যত দক্ষ হবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গলজনক। অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘রাজশাহী ওয়াসা সার্ফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ শীর্ষক প্রকল্পের জন্য ২৭ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ চাওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ দেওয়ায় সম্মতি জানিয়ে ১৬ জানুয়ারি একটি ঋণচুক্তির খসড়া পাঠায় চীন।

প্রিফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিটের (পিবিসি) ঋণ চুক্তি খসড়াটির ওপর ২৭ ফেব্রুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। ৭ মার্চ জারি করা হয় সভার কার্যবিবরণী। এরপরই চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের মতামত জানিয়ে প্রস্তাব পাঠায় ইআরডি। জানতে চাইলে ইআরডির উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘চীনা ঋণের শর্ত সব সময়ই কঠিন হয়। শুধু এ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তারা কঠিন শর্ত চাপিয়ে দিতে চায়। পরে আলাপ-আলোচনার পর কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতা হলেই শুধু ঋণচুক্তি হয়। তবে চীন অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে।রাজশাহী ওয়াসার ঋণের শর্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইআরডির পক্ষ থেকে চীনকে বাংলাদেশের আপত্তির বিষয়গুলো জানানো হয়। এরপরই তাদের সঙ্গে আলোচনার পর অনেক শর্তই শিথিল হয়ে যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা যুগান্তরকে বলেন, ‘দরকষাকষির দক্ষতার চেয়ে এখানে বড় বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব। এখন দেশটির (চীন) সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের ক্ষেত্রে তারা অনেক নমনীয়। ফলে যে কোনো শর্তই তারা আমাদের চাহিদাকে সম্মান দিয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু রাজশাহী ওয়াসার প্রকল্পেই নয়, অন্য সব প্রকল্পের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। এছাড়া চীনের বাজারে আমাদের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা প্রথমে ৯৭ শতাংশ ডিউটি ফ্রি সুবিধা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ৯৮ শতাংশ ডিউটি ফ্রি সুবিধা দিয়েছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটিতে সরকার একপর্যায়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। কিন্তু পিপিপির মাইলফলক এ প্রকল্পের অর্থায়নে চীন সরকার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এখন আমরা চলাচলের সুবিধা পাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০২৬ সালের পর এলডিসি উত্তরণ হয়ে গেলে আমরা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক সুযোগই হারাব। সেক্ষেত্রে ট্রেডে যাতে কোনো বাধা না আসে এজন্য চীনের সঙ্গে এফটিএ (ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট) করার বিষয়ে উভয়পক্ষ অনেকদূর এগিয়েছে। ইতোমধ্যেই একটি বৈঠকও হয়েছে। চীনের পক্ষে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও শেষ করা হয়েছে। সবকিছুই হচ্ছে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে।সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় স্বাক্ষর হয় ‘স্ট্রেনদেনিং ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপারেশন’ শীর্ষক এমওইউ। সেখানে রাজশাহী ওয়াসার প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত আছে। পরে আরও আলাপ-আলোচনার পর এ প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি এগিয়ে যায়। চীনের পাঠানো ঋণচুক্তির প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সুদের হার হবে ২ শতাংশ। ব্যবস্থাপনা ফি হিসাবে এককালীন দিতে হবে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থ। এছাড়া প্রতিশ্রুতি ফি হিসাবে ছাড় না হওয়া অর্থের ওপর বাৎসরিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ দিতে হবে।

কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা ও প্রতিশ্রুতি ফি কমানো দরকার। কেননা দ্বি-পাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণে কোনো কমিটমেন্ট ফি নেই। ভারতের কমিটমেন্ট ফি মোট অছাড়কৃত অর্থের ওপর ধার্য না করে পৃথক প্যাকেজভিত্তিক ধার্য করা হয়। বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক এই ফি নিচ্ছে না। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে আছে মাত্র শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ। সেইসঙ্গে অধিকাংশ উন্নয়ন সহযোগীর ঋণে ব্যবস্থাপনা ফি নেই। কোনো কোনো ঋণে থাকলেও তা অত্যন্ত কম। চীনের প্রস্তাবিত ঋণে ম্যাচুরিটি পিরিয়ড হিসাবে ২০ বছর ধরা হয়েছে। কিন্তু জাপানের ম্যাচুরিটি পিরিয়ড ৩০ বছর, দক্ষিণ কোরিয়ার ৪০ বছর। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ৩০-৩৮ বছর এবং এডিবির ২৫ বছর। ফলে চীনা কর্তৃপক্ষকে ম্যাচুরিটি পিরিয়ড আরও ৫ বছর বাড়িয়ে ২৫ বছর করার প্রস্তাব দিতে হবে।

সূত্র আরও জানায়, খসড়া ঋণচুক্তিতে গ্রেস পিরিয়ড (রেয়াতকাল) এবং অ্যাভেইলিভিলিটি (সহজলভ্যতা) পিরিয়ড উভয়ই ৬০ মাস ধরা হয়। এক্ষেত্রে সময় বাড়িয়ে ৭২ মাস করার প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। খসড়া ঋণ চুক্তি আর্টিকেল-৭ ধারা অনুযায়ী চীনা কর্তৃপক্ষের পলিসিগত পরিবর্তনের ফলে কোনো শর্ত ছাড়াই নোটিশ দিয়ে প্রকল্পে অর্থায়ন সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে পারবে বলে উল্লেখ ছিল। এটি নেগোশিয়েশনের মাধ্যমে সুরাহার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় ইআরডিকে। ওই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন বলেছিলেন, খসড়া ঋণ চুক্তি আর্টিকেল ৭-এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশের পক্ষের বিভিন্ন ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা কর্তৃপক্ষেরও ত্রুটি হতে পারে। যেমন-কিছু ক্ষেত্রে কোনো বিষয় চীনা পক্ষের কাছে দীর্ঘদিন পড়ে থাকে। তাদের পক্ষে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

এর ফলে আর্থিকভাবে আমাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। চীনের পাঠানো খসড়া ঋণচুক্তিতে আরও বলা হয়েছিল, উভয়পক্ষের অধিকার ও বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে চীনা আইন প্রযোজ্য হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পক্ষের জন্য বাংলাদেশের আইন প্রযোজ্য হওয়া বিষয়টি উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় মতামত দেওয়া হয়। এই ঋণচুক্তি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয়ে সালিশের জন্য নির্ধারিত স্থান হিসাবে বেইজিং উল্লেখ করা হয়েছিল খসড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশ মনে করে স্থানটি চুক্তিকারী দেশের বাইরে তৃতীয় কোনো দেশ হওয়া উচিত। ওই সময় দরকষাকষির সঙ্গে যুক্ত ইআরডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘তারা যে ঋণ বাতিলের কথা বলেছিল সেটি আর হবে না। কেননা তাদের নীতিমালায় পরিবর্তন হলে তারা আমাদের জানাবে। এরপর যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে প্রক্রিয়াগত পদ্ধতির সব ধাপ পার হয়েই করতে হবে।

তারা চাইলেই হঠাৎ করে ঋণ বাতিল করতে পারবে না। এছাড়া ঠিকাদারদের গাফিলতিসহ যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের জন্য সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় দেশ হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।রাজশাহী ওয়াসা সূত্র জানায়, ১০ মে চীনের সঙ্গে রাজশাহী ওয়াসার জন্য ঋণচুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চাওয়া অনুযায়ী রেয়াতকাল ও ঋণ পরিশোধের সময় বেড়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য ফিও সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। প্রকল্পের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক পারভেজ মামুদ বলেন, ‘ইতোমধ্যেই চীনের দেওয়া ঋণের অর্থছাড় হয়েছে। এখন কোনো সমস্যা নেই। আমরা সাইট ডেভেলপ করছি এবং নকশা তৈরির কাজ করছি।

এগুলো হয়ে গেলে পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হবে। এ বিষয়ে রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পের কার্যক্রম ভালোভাবেই চলছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর আর কোনো জটিলতা নেই।ইআরডি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় রাজশাহী ওয়াসার জন্য ঋণসহ মোট ২৭টি প্রকল্পে অর্থায়নে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে গত ৭ বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে তিনটি প্রকল্প। এগুলো হলো-কর্ণফুলী টানেল, রাজধানীর দাশেরকান্দিতে পয়ঃশোধনাগার প্ল্যান্ট এবং ফোর টায়ার জাতীয় ডেটা সেন্টার স্থাপন প্রকল্প। এছাড়া চলমান আছে সাতটি। এসব প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ৪২৮ কোটি ডলার।