আন্তর্জাতিক

শান্তির একমাত্র উপায় পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা

গাজায় সামরিক অভিযান অবিলম্বে বন্ধ এবং সব জিম্মি ও বন্দিদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন সউদী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। গাজা সংকট নিরসনে সউদী আরবের রাজধানী রিয়াদে গতকাল শুরু জয়েন্ট আরব ইসলামিক এক্সট্রাঅরডিনারি সামিটের সূচনা বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনে আরব লীগ নেতাদের উদ্দেশে সউদী যুবরাজ বলেন, ‘এটি এমন এক মানবিক বিপর্যয়, যা ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের চরম লঙ্ঘন বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতা এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের দ্বৈতনীতির প্রমাণকে স্পষ্ট করেছে’।

মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, ‘এখন শান্তির একমাত্র উপায় হলো- ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও অবৈধ বসতি স্থাপনের অবসান, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিষ্ঠিত অধিকার পুনরুদ্ধার এবং ১৯৬৭ সালের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা’। সম্মেলনে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই তার দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা পালন করতে হবে, যাতে অবিলম্বে আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে এই প্রতিহিংসামূলক যুদ্ধের অবসান ঘটানো যায়’। ‘আমরা মার্কিন প্রশাসনকে ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং আমাদের পবিত্র স্থানের দখল ও সেখানকার পবিত্রতা লঙ্ঘন বন্ধের আহ্বান জানাই’, যোগ করেন তিনি।

মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘আমাদের নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষা প্রয়োজন এবং আমরা তা চাই। কেননা পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর পাশাপাশি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা প্রতিদিনই হামলা করছে। এজন্য কোনো সামরিক ও নিরাপত্তা সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এখানে সবই ব্যর্থ হয়েছে। গাজা বা পশ্চিম তীর থেকে আমাদের জনগণকে বাস্তুচ্যুত করার যেকোনো প্রচেষ্টা আমরা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছি’, বলেন তিনি। এদিকে ফিলিস্তিন টিভি জানিয়েছে, অবরুদ্ধ গাজা ছিটমহলের আল শিফা হাসপাতালের একটি সার্জারি ভবনকে লক্ষ্য করে ইসরাইল বোমা হামলা চালিয়েছে।

গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল কুদরাও বলেছেন, ইসরাইল হাসপাতালে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে এবং মিডিয়াতে ছবি প্রচারে বাধা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আল শিফা হাসপাতাল কমপ্লেক্সে জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় অপারেশন স্থগিত করা হয়েছে’। আল কুদরাও রয়টার্সকে বলেছেন, ‘ফলস্বরূপ, একটি নবজাতক শিশু ইনকিউবেটরের ভিতরে মারা গেছে, যেখানে ৪৫টি শিশু রয়েছে’। ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বলেছেন যে, গাজা শহরের উপচেপড়া হাসপাতালের কাছে লড়াই তীব্র হয়েছে, বিস্ফোরণ এবং বন্দুকযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সেলমেয়াহ বলেছেন, ‘ইসরাইল এখন গাজা শহরের হাসপাতালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করছে’। তিনি পরে বলেন, গাজা শহরের আল বুরাক স্কুলে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছে আর লোকেদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।

গাজার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার ভোররাতে ছিটমহলের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল শিফার আঙ্গিনায় ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে। এতে ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নাসের রান্টিসি পেডিয়াট্রিক ক্যান্সার হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানা গেছে। গাজা নিয়ে কথা নয়, প্রয়োজন অ্যাকশন -রাইসি : সঙ্কট নিয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সউদী আরব যাওয়ার সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, কথা বলার পরিবর্তে গাজা যুদ্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। সউদী আরবের রিয়াদের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে তেহরান বিমানবন্দরে রাইসি বলেন, ‘গাজা শব্দের ক্ষেত্র নয়, এটি কর্মের জন্য হওয়া উচিত’। তিনি আরো বলেন, আজকে ইসলামি দেশগুলোর ঐক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গাজা সংকট সমাধানে ইতিবাচক সংকেত পেয়েছে আঙ্কারা : গাজা সংকট সমাধানের ব্যাপারে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় আঙ্কারা ইতিবাচক সংকেত পেয়েছে বলে জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম হুরিয়াত ডেইলি জানিয়েছে, উজবেকিস্তান সফর শেষে দেশে ফিরে গত শুক্রবার রাজধানী আঙ্কারায় কথা বলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। এ সময় গাজা সংকট সমাধানে তার দেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সম্পর্কেও বক্তব্য রাখেন তিনি। খবরে বলা হয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে তুর্কি নেতা বলেন, আমরা যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ‘সবুজ সংকেত’ পেয়েছি।

এরদোগান আরো বলেন, গাজা থেকে আহতদের স্থানান্তর করার জন্য একটি করিডোর খোলারও চেষ্টা চালিয়েছে তুরস্ক। ওই প্রচেষ্টার ব্যাপারেও ইতিবাচক সংকেত পেয়েছে আঙ্কারা। তিনি বলেন, করিডোর খোলার বিষয়টি শুধু মানবিক ত্রাণ স্থানান্তরের জন্যই নয়। আমরা নিপীড়িত ও আহত ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের নিশ্চয়তা দিতে ইসরাইলের ওপর চাপ বাড়াতে চাই। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বেসামরিক বন্দিদের আটক রাখতে চায় না। সুতরাং ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিদের পারস্পরিক মুক্তির একটা প্রক্রিয়া খুবই প্রয়োজন।

গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। তাদের এ হামলা থেকে মসজিদ, গির্জা, স্কুল, হাসপাতাল ও বেসামরিক মানুষের ঘরবাড়িসহ গাজার কোনো অবকাঠামো বাদ যাচ্ছে না। গত এক মাসে এ হামলায় গাজা ও পশ্চিমতীরে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোর ওপর ২৫০টিরও বেশি এবং ইসরাইলে ২৫টি হামলা হয়েছে। এতে জাতিসংঘের ১০০-এর বেশি কর্মী নিহত হয়েছেন। ইরাইলের বর্বর এ হামলায় ইতোমধ্যে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজারে পৌঁছেছে। নিহত এসব ফিলিস্তিনির মধ্যে সাড়ে চার হাজারের বেশিই শিশু। ভয়াবহ হামলা অব্যাহত থাকার কারণে ভেঙে পড়েছে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা।

অপর এক খবরে বলা হয়, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় দখলদার ইসরাইলের হামলায় নিহতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। নিহতদের প্রায় সবাই শিশু, নারী ও বেসামরিক নাগরিক। গাজায় প্রতি ১০ মিনিটে একজন শিশুর মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস। শুক্রবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরাইলি হামলায় শহরে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৮ জন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৬ জন শিশু। গাজায় নিহত নারীর সংখ্যা ৩ হাজার ২৭ জন।

ইসরাইলি বাহিনীর ভয়াবহ বিমান হামলায় গাজা সিটির আল-বুরাক স্কুলে অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার এ হামলার ঘটনা ঘটে। গাজার বৃহৎ চিকিৎসাকেন্দ্র আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, হামলার পর হাসপাতালে এসব মরদেহ নিয়ে আসা হয়। গাজায় আঘাতপ্রাপ্ত অসংখ্য ব্যক্তি এবং গর্ভবতী নারীদের সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা কোনো রকম চেতনানাশক ছাড়াই অস্ত্রোপচার করছেন। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় জ্বালানি সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে সেখানকার অন্যতম আল শিফা হাসপাতাল। গত ৪৮ ঘণ্টায় বন্ধ হয়ে গেছে আরও ৩টি হাসপাতাল। এছাড়া আল কুদস হাসপাতালের আইসিইউতে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।

গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভয়াবহ আকার নিয়েছে বলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস। গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতালগুলোর একটি ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালও বিদ্যুৎ সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। গাজার আরেকটি হাসপাতাল আল কুদসের আইসিইউ লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। রোগীতে পরিপূর্ণ থাকা আল শিফা হাসপাতালও জ্বালানি সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান শুক্রবার বলেছেন, গাজার অর্ধেক হাসপাতালই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনি উপত্যকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা চূড়ান্ত সীমায় রয়েছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে তিনি বলেন, গাজার ৩৬টি হাসপাতাল এবং এর দুই-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অর্ধেকই কাজ করছে না। যেগুলো কাজ করছে তারা তাদের সামর্থ্যের বাইরে কাজ করছে। তিনি বলেন, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা চূড়ান্ত সীমায় রয়েছে। তবু কোনো না কোনোভাবে জীবন রক্ষার জন্য লড়াই অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেন, সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের এখন ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জ্বালানির প্রচণ্ড প্রয়োজন।

সেখানে প্রতি ১০ মিনিটে একটি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তবে সেখানে কোথাও এবং কেউ নিরাপদ নয়। ডব্লিউএইচও প্রধানের মতে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চারটি হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে জ্বালানির অভাবে। হাসপাতালগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩০ শয্যা ছিল। তবে এর চেয়েও অনেক বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। ইসরাইলের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত শতাধিক জাতিসংঘের কর্মী নিহত হয়েছেন। সূত্র : তাস, রয়টার্স, হুররিয়াত ডেইলি, আনাদোলু ও টিআরটি ওয়ার্ল্ড।