এক্সক্লুসিভ

যে গ্রামে ১১০ বছর পর হলো মেয়ের বিয়ে

১১০ বছর পর গ্রামে ঢুকেছে প্রথম কোনো বরযাত্রী। শুনতে অবাক লাগলে বা প্রাচীন কোনো কাহিনি মনে হলেও বিষয়টা তেমন নয়। এটি ২০১৯ সালের একটি বাস্তব কাহিনি। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের রাজস্থানে। দেশটির সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্থানের জয়সলমের এবং বারমের জেলায় এমন কয়েকটি গ্রাম রয়েছে যেখানে জন্ম এবং মৃত্যু একই সঙ্গে আসে। এ সব গ্রামে কন্যাসন্তানদের জন্মের পরই মেরে ফেলা হয়। গ্রামগুলোতে কন্যা সন্তানদের অভিশাপ বলে মনে করা হয়। ফলে বহু পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে মেরে ফেলার রীতি রয়েছে।

রীতিতে বিশ্বাসী নয় এমন স্থানীয়দের একাংশ জানান, বিষয়টি নিয়ে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন অবগত। এমনকি পুলিশও বিষয়টি জানে। সরকারের পক্ষ থেকে এটি আটকানোর চেষ্টা করলেও তেমন কোনো লাভ হয়নি। তবে বিভিন্ন সমীক্ষা অনুসারে বর্তমানে এমন ঘটনা অনেক কমেছে। তবে এখনও এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

সংবাদমাধ্যম ‘ক্রাইম টক’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, জয়সলমের এবং বারমের জেলায় এমন ছয়টি গ্রাম রয়েছে। এসব গ্রামে কন্যাসন্তান জন্মের হার অনেক কম। গ্রামগুলো হলো দেওড়া, তেজমালতা, মোরা, রাসলা, ডোগরি এবং মোরান। এরমধ্যে এমন একটি গ্রাম রয়েছে যেখানে ১১০ বছর পর কোনো মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ওই গ্রামটির নাম দেওড়া।

গ্রামটিতে ১১০ বছর পর ২০১৯ সালে প্রথম কোনো মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বর, বরকন্দাজ নিয়ে বরযাত্রী সেই গ্রামে ঢুকেছিল ১১০ বছর পর।জয়সলমেরের দেওড়া ছাড়া তেজমালতা, মোরা, রাসলা, ডোগরি এবং মোরান গ্রামেও এমন প্রথা রয়েছে। সেখানে অনেক কন্যাসন্তানকেই পৃথিবীর আলো দেখার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মেরে ফেলা হয়।

রাজস্থানের গ্রামগুলোতে এমন প্রচলনের বিষয়ে জানা যায়, মুঘলরা রাজস্থানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে আধিপত্য বিস্তারের সময় তাদের সেনারা মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজপুত মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করত। বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হতো তাদের। মূলত রাজপুতদের অপমান করতেই নাকি এই জুলুম চালাত মুঘলরা। আর তাই বাড়ির মেয়েদের মুঘল সেনাদের লালসা এবং অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতেই না কি জন্মের পরে কন্যাসন্তান মেরে ফেলার প্রথা চালু হয় রাজস্থানের বহু গ্রামে।

মুঘলদের পর ব্রিটিশরা এসেছে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনও হয়েছে। তবে কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলার এই প্রথা বন্ধ হয়নি। কেবল মেরে ফেলার কারণ বদলেছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়েদের পড়াশোনা এবং বিয়েতে খরচ বাঁচানোর জন্যই না কি এখন জন্মের পর তাদের মেরে ফেলা হয় রাজস্থানের বহু গ্রামে। সেই প্রথা এখনও প্রচলিত বহু পরিবারে।

এসব গ্রামে বেশির ভাগ সময়ই সন্তানসম্ভবাদের প্রসবের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় না। গ্রামের বয়স্ক মহিলাদের সাহায্যেই সন্তানের জন্ম হয়। যারা কাজটি করেন তাদের ‘দাই মা’ বলে। এ নারীদেরই কন্যাসন্তান জন্ম নিলে মেরে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে দাই মা রাজি না হলে জন্মদাত্রীর উপরেই এটি এসে বর্তায়।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জন্মের ১-২ ঘণ্টার মধ্যেই কন্যাসন্তানদের মেরে ফেলা হয়। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে ভারী বালিশ বা মাটির ছোট বস্তা বাচ্চাটির মুখের ওপর রেখে দেওয়া হয়।

যাতে মনে হয়, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু হয়েছে সন্তানের।গ্রামগুলোতে এসব কন্যাসন্তানদের আফিম খাইয়ে দেওয়া, মুখে এবং নাকে বালু বা তুলো ঢুকিয়ে হত্যার প্রথা রয়েছে। হত্যার পর এসব শিশুদের মরদেহ রাজস্থানের মরুভূমির বালির নিচে চাপা দেওয়া হয়।জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পর এ নিয়ে সরকার উদ্যোগী হয়েছে।

প্রশাসনের দাবি, বর্তমোনে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। তবে এ প্রথা বন্ধ হয়নি এখনও।গ্রামে কন্যাসন্তান হত্যার প্রভাব পড়েছে পুরুষদের ওপরও। দেওড়াসহ এ ছয় গ্রামে বহু পুরুষ অবিবাহিত থেকে যান। তারা বিয়ের জন্য উপযুক্ত মেয়ে খুঁজে পান না। এ ছাড়া কন্যাসন্তান মেরে ফেলার রীতির কারণেও অনেক পরিবার এই গ্রামগুলোতে মেয়েদের বিয়ে দিতে রাজি হন না।

%d bloggers like this: